নয়নতারার ঘ্রাণ
অশোক দেব
অন্ধকার। কিন্তু ওই যে শোনা যাচ্ছে সে কি ধ্বনি নাকি আলোর ধ্বনিরূপ? রাইচাঁদ
বাজাচ্ছে। অন্ধকারে দেখতে পান? আমি পাই। রাই যখন বাজায় তখন আলো বিচ্ছুরিত হয়। সেই
অদ্ভুত আলোতে কী দেখা যায়? দেখা যায় আমাদের রাইচাঁদ কাঁদছে। অবিরল ধারায় ঝরছে অশ্রু।
রাইয়ের বাদ্যের আলোকে স্পষ্ট হয় সামনের আসন। উদ্বাহু শ্রীচৈতন্য, নিতাইচাঁদ আর
একটু ওপরে রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তি। এখন যে তাল বাজাচ্ছে রাই, তা আসলে কোনও তাল নয়।
কথা বলছে সে। শ্রীখোলই বলে দেয় তার কথাগুলো। মাঝে মাঝে যখন অশ্রুর তোড় আসে, তখন
বামের থেকে গুমগুম করে ওঠে। তারপর এই মাটির তৈরি বাদ্যযন্ত্র বিলাপ করতে শুরু করে।
আনন্দময় শ্রীখোলের কান্না যে শোনেনি, সে কী শুনেছে?
একটা বটগাছ আছে। তার বয়স কত? তার নীচে একটা দালান আছে।
চারদিক খোলা। আর আছে ঠাকুর। সেই শ্রীরাধাকৃষ্ণের যুগল। সন্ধ্যায় সেখানে লোকে
কাঁদতে আসে। কারণ, কীর্তন হয়। সবার থেকে বেশি কাঁদে বাবুলের মা। বাবুলের মায়ের ষাট
হবে বয়স। কিন্তু, বাবুলকে কে দেখেছে? কবে কোন অতীতে সে জলে ডুবে মরে যায়। বাবুলের
বাবা সেই থেকে কথা বলে না। নিজের কাজটুকু করে যায়। কথা বলে না। কেউ তাকে কথা বলতে
শোনেনি। কী এমন ছিল বাবুল যে, সে চলে গেলে একজন মানুষের কাছে পৃথিবীকে বলবার মত আর
কিছু থাকে না? বাবুলের মায়ের কান্না কেমন? ওই রাইচাঁদ দাসের বাজনার মতন? না। তিনি
তাকিয়ে থাকেন শ্রীবিগ্রহের দিকে। শ্রীরাধিকাকে একদৃষ্টে দেখেন। পায়ের দিকে নয়।
মুখের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকেন। আর তার অশ্রুর খনি খুলে যায়। অবিরল। এদিকে
কীর্তন গেয়ে চলে যায় হারুর বাবা, নিতাই গোস্বামীর পাঠও শেষ হয়, শেষ হয় মালতির
নৃত্য এবং প্রণাম। সবাই চলে গেলে আমাদের রাইচাঁদ বাবুলের মায়ের সামনে যায়। বসে।
—
এত কিরে কান্দো?
—
জানি না রে বাপ, আমার
উথাপাথাল অয়
—
বাবুলরে মনে পড়ে
বুঝি?
—
পোলাডারে দুধ
খাওয়াইতে পারলাম না আমি। মাত্র হামা দেওন শিখছিল। ক্যামনে যে গিয়া কুয়াত পইরা গেল...
—
ইস
—
তে যাওনের পরে কী
যন্ত্রণা, কী টনটন, বুকে দুধের চাপ...
হাহাকার করে ওঠে বাবুলের মা। প্রায় চিৎকার করে জড়িয়ে ধরে রাইচাঁদকে। রাইও তখন
কাঁদে। হা প্রভু, হা প্রভু। ঠিক কী রকম হতে পারে এই টনটন? স্তন্যপান কেমন?
জন্মকালে মাতৃহারা রাই জানেও না স্তন্যপান ঠিক কী রকম হয়।
দয়াল সংঘ। রাইচাঁদের দল। তারা
ঘুরে ঘুরে নামকীর্তন করে। দূর দূর থেকে ডাক আসে। বছরে একদিনও বাদ পড়ে না প্রায়।
শীতকালে তো একদমই না। তখন রাইচাঁদের শরীর লতানে হয়ে যায়। শ্রীখোলের তালে তালে সে
তার নরম পা মাটিতে বোলায়। আর পৃথিবীকে তালবাদ্য শেখায়। যারা গায়েন, মাঝে মাঝে তারা
রাইকে আসর ছেড়ে দেয়। ওপর থেকে ঝুলে থাকা মাইকের নীচে প্রায় ত্রিভঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়
রাই। বাজায়। সারা মাঠ জুড়ে উলুধ্বনি গুঞ্জরিত হয়। এমন যে এমন, সামান্য বয়সের বউরাও
তাতে যোগ দেয়। রাই তার শ্রীখোলকে নিয়ে খেলা জুড়ে দেয়। এদিকে কাত হয়, গমক গমক। সোজা
হয়ে একটু নরম নরম কথা বলিয়ে নেয়। তারপর একটু হাহাকার যোগ করে দিয়ে ফিরে আবার মূল
তালে আসে। আবার গায়েনের দিকে তাকিয়ে নেয় একটু। তারপর ঝলমল করে এসে সম-এ পড়ে।
হরিবোল, হরিবোল। রাইয়ের বাবরি চুলে তুফান থামিয়ে একটু দাঁড়ায়। সে ঠেকায় ঠেকায়
গায়েনকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। এ বাদ্য দূর হতে শুনেছে যে, সে বাড়িতে থাকতে পারে না। রাত
দশটার পরে মাইক বাজানো নিষিদ্ধ। কিন্তু রাইকে বাজনায় পেলে আয়োজকেরা ধার ধারে না
এসব। বড়োবাবু আসে, তবুও না। এরপর আসেন খোদ এসপি সাহেবা। লম্বা। পুলিশের পোশাক পরা
জাঁদরেল মহিলা। উত্তরপ্রদেশ না কোথাকার। হিন্দি বলে। তিনি যখন আসেন, তখন আমাদের রাই
তার শ্রীখোলের সঙ্গে নিজের আত্মীয়তা বাজিয়ে দেখাচ্ছিল। গাড়ি থেকে নেমে সেই যে
দাঁড়ালেন এসপি, নড়নচড়ন নেই। একজন পুলিশ আসে। রাইয়ের কাছে যায়। একটা হাজার টাকার
নোট তার পাঞ্জাবিতে গেঁথে দিয়ে এসপি সাহেবাকে দেখায়। মানে, উনি পাঠালেন। রাই শ্রীখোল তুলে নমস্কার
জানায়। কিন্তু তার বাদন বন্ধ হয় না। ফিরে
যায় পুলিশ। আবার মাঠজুড়ে উলুধ্বনি।
কিন্তু, এই যে একা বসে
অন্ধকারে বাজাচ্ছে রাই, কী বাজায়? তার বাজনার থেকে আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে। খালি গা।
রোমহীন পেলবকান্তি। ভক্তিলাবণ্য? গোহালে কয়েকটি গাভী, তাদের বাছুর। জল নেই সামনের
পাত্রে। তারা ডাকে। রাইচাঁদের
খেয়াল নেই। বাজায়। বছরে যে-কদিন বায়না থাকে না, রাইচাঁদ মাখন বিক্রি করে। ধলী,
কালী, ললিতা, বিশখা তার আদরের গাই। রাইয়েরা আসলে ঘোষ। বাবার মিষ্টির দোকান ছিল।
বেশ নামডাক। দাদারা মিলে সব ভাগাভাগির তাল তুললে রাই সেসব থেকে সরে আসে।
স্বেচ্ছায়। একটুকু ভিটে, দুতিন কানি ধানের জমি আর গাইগুলো তার ভাগে আসে। না চাইতেই
দিয়ে যায় দাদারা। রান্নাবান্না স্বপাক।
একেবারে সামান্য। কিন্তু সকাল সন্ধ্যা মিছরি দিয়ে দুধ খেতে হয়, এক ঘটি। কাঁসার
একটি ঘটি আছে। সোনার মতন চকচক করে। ঠাকুরের তৈজস সহ রাইয়ের সকল কিছু কাঁসার। নিজেই
মেজে মেজে সোনার মতন করে রাখে। রাইচাঁদের ঘরদোর দেখলে তত বড় গিন্নিও লজ্জা পাবে,
এমন পরিপাটি। মাটির ঘরে থাকে সে। ঠাকুর
থাকেন ইটের দালানে। বাহারি করে বানানো ঠাকুরঘরের সামনে ছোট্ট একটা নাটও রয়েছে। রয়েছে প্রদক্ষিণ করবার
মতন চারবারান্দাও। রাই ঠাকুরঘরের দরোজা
বন্ধ করে দিয়ে অন্ধকারে শ্রীখোল দিয়ে আত্মকথা রচনা করে। সে কথা সে রাধাকৃষ্ণ,
শ্রীচৈতন্য, নিতাইচাঁদকে শোনায়। শোনায় গোপালজীকে। সামনের ছোট পেতলের আসনে
শ্রীগোপাল হাসি-হাসি মুখ করে তাকিয়ে আছেন রাইচাঁদের দিকে। রাইচাঁদ ঘোষ, দীক্ষা
নিয়ে দাস হয়েছে।
রেলগাড়ি এসেছে এখন। নতুন।
সকালে আগরতলা হতে আসে একটা গাড়ি। আবার সাড়ে আটটার দিকে ফিরে যায়। এখানে দূর দূর
মাঠ। সেটা পেরিয়ে গেলে টিলা, রাবারের বাগান। তার কোনো আড়াল দিয়ে রেলগাড়িটা আসে
যায়, রাইচাঁদ জানে না। সে তো রাতে ঘুমায় না। ঠাকুরঘর থেকে বেরিয়ে গোহালে গিয়ে
গরুগুলো দেখে আসে। হাফ ওয়াল করে পাকা করা গরু ঘর। উপরে টিন। সিলিঙ্গে ফ্যান আছে।
বাছুরের জন্য আলাদা ভাগ করা আছে ঘরে। ভোরের দিকে গিয়ে ফ্যান অফ করে দিতে হয়। গরুর
ঠান্ডা লেগে যায়। এসব করে এসে রাই যখন বিছানায় আসে, ভোরকীর্তনের সময় হয়ে যায়। তার
আগে আধ ঘণ্টাটাক তন্দ্রা-তন্দ্রা, ঘুম ঘুম। আজকাল আর ভোরকীর্তনে কেউ বেরোয় না। আগে
অর্চনা বৈষ্ণবী আসত। তার বাড়িতে এলে সঙ্গে রাইও বেরিয়ে পড়ত তার সঙ্গে। একটা
টিমটিমে ধোঁয়া-ওঠা হ্যারিকেন হাতে নিয়ে অর্চনা এবাড়ি ওবাড়ি যেত। তার বুঝি দেনা
শোধের বিষয় আছে, যেন এই ঘুমন্ত মানুষগুলো তাকে তাড়া দেয়। অর্চনা বৈষ্ণবী গেয়ে গেয়ে
বেড়াত। তত মধু ছিল না তার কণ্ঠে। কিন্তু আদর ছিল। গ্রামটা পুরো মুখস্থ তার। কার
বাড়ির ছেলেটার জ্বর, কোন বাড়ির বউ বাপের বাড়ি গিয়ে আর ফিরছে না, কার বাড়ির মেয়েটা
নষ্ট হয়ে যাচ্ছে... ভোর হলে অর্চনাকে মনে পড়ে রাইয়ের। কোথাকার কে যেন তাকে নিয়ে
গিয়েছে। কেউ তো নেই, শেষকালে কী হবে খুব ভাবত সে। এখন বোম্বাই না কোথায়, কাদের ঘরে
ছেলে রাখে সে। কী করে যে তার ভোরকীর্তন ফেলে রেখে চলে গেল। ঘুম আসে না। পাশের অত
বড় করই গাছটাকে একটা মাধবীলতা পুরো দখল করে নিয়েছে। আসল গাছ আর দেখাই যায় না। মনে
হয় মাধবীলতাই আসল। তার আড়াল থেকেই প্রথম পাখি ডাকে। রাই আরেক দফা বাজিয়ে নেয়। যেন
সে বাজনা ছাড়া অর্থহীন, যেন বাজনাটাই আসল রাইচাঁদ। রেলগাড়ির শব্দ শোনা গেলে থামে।
স্নান করে। ঠাকুর জাগায়। গাই দোহাতে যায়।
কে বলে নয়নতারার গন্ধ নেই?
রাইচাঁদের সারা বাড়িতে নয়নতারার গাছ শিশুর মতন খেলে, বাড়ে। সারা বাড়িতে ফুটে থাকে।
হাসে, দোলে। গাই দোহাতে গেলে রাই এর সুগন্ধ পায়। সুঘ্রাণে ভরে যায় এমনকি তার
ভেতরটাও। গাইগুলোর নানা জাত। পালা করে দুটিতে দুধ দেয়, দুটি গর্ভবতী থাকে। ধলী আর
কালী দেশি। ললিতা নেপালি আর বিশখা জার্সি। এখন ওরা গর্ভবতী। রাই ধলীর কাছে যায়।
তার বকনাটার নাম বংশী। তাকে ছেড়ে আসে। ছুটে এসে মায়ের স্তনের বোঁটায় জুটে যায়
বংশী। পৃথিবীতে এর থেকে সুন্দর দৃশ্য কি আছে? রাইচাঁদের সাদা রঙের গাভী সারা
পৃথিবীর পুলককে তার চোখে ধারণ করেছে। আর অবশ হয়ে যেতে থাকে রাই। এত বাৎসল্য এই
অবলা প্রাণে কোথা হতে আসে? একটু একটু করে সে চেটে দেয় সন্তানের শরীর। আর ওই বাছুর
অযথা ঠুসে দেয়, আঘাত করে মায়ের দুধের ভাণ্ডে। কোথাও একটা গিয়ে লাগে রাইয়েরও। কেমন
একটা ঝিম ধরানো পুলক লাগে তার। আর সেটা সে দেখে ধলীর মধ্যেও। দুগ্ধের ধারাস্রোত
আরও বেড়ে যায় তখন। আনন্দে ঘন ঘন লেজ নাড়ে বাছুরটি। হুহু করে ওঠে রাইচাঁদের বুক।
কোথাও একটা আনন্দ হয়, আবার কী যেন হারিয়েও যায়। হাফওয়ালের ফাঁক দিয়ে দূরের
গাছপালার দিকে তাকায় রাই। সারা বাড়িতে ছড়িয়ে থাকা নয়নতারা দেখে। দুলছে, হাসছে।
তারাও তো সন্তান, বসুন্ধরার দুধ খেয়ে বেঁচে আছে। রোদের দুধ খেয়ে। কী যেন মনে পড়ে
রাইয়ের। ছুটে চলে আসে ঠাকুরঘরে। গোপালজী কি অপরাধী? রাইচাঁদ গিয়ে তাঁকে ধরে।
—
আমি কী দোষ করলাম
ঠাকুর? সবাইরে দও আমারে দও না। আমি কী আর এমন কঠিন জিনিস চাইলাম?
গোপালজী তাকিয়ে থাকেন। চোখে হাসি, ঠোঁটেও। রাইচাঁদের কথা শুনে যেন আরো বেশি
করে হাসেন।
আমাদের রাইচাঁদ নারী হতে চায়। আসলে স্তন্যদানের পুলক পেতে চায়। নিজের
বুকের দুধ সে খাওয়াতে চায় স্বয়ং গোপালজীকে। এ কথা কেউ জানে না। রাই জানে আর জানেন
গোপালজী। নিজে তো পারে না। তাই সে বাজনায় বাজনায় স্তন্যদান করে। সেই সুমধুর
বাদ্যধারায় সে গোপালজীকে তৃপ্ত করতে চায়। আর সেই একই গোপন আর্জি পেশ করে চলে তার
গোপালজীর কাছে। আজও, সেই ভুলেই গেল দুধ দোহাতে। চলে এল ঠাকুরঘরে। বাৎসল্য আর আনন্দ
তাকে ঠেলে গোহাল থেকে বের করে দিয়েছে। কিন্তু এই যে একই প্রার্থনা সে জানিয়ে
যাচ্ছে, সে কবে থেকে? যেদিন সে জেনেছে, মায়ের দুধ পায়নি সে। ধাত্রীও জোটেনি। যেদিন এ কথা জেনেছে, সেদিন
থেকে? জানে না। বরং বুড়ো হয়ে যাচ্ছে রাইচাঁদ। যা কখনো হয়নি সে হচ্ছে আজকাল।
অনেক্ষণ বাজালে তার কাঁধে ব্যথা হচ্ছে। কিন্তু আসল কাজ তো হল না। কবে হবে? কবে?
আজ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে রাই।
বৃথা এই চেষ্টা। আমাকে তুমি দেবে না, আমিও তোমাকে দেব না আর। আজ থেকে ঠাকুরকে আর
বাজিয়ে শোনাবে না। বাদ। ঠাকুরঘরে যাবে না। সেই কবে কোন বালক বয়স থেকে সে বাজায়।
নিজেই শিখেছে। নদীয়া থেকে এসেছিল গোপাল গোস্বামী। তার বাজনা শুনেই পাগল হয়েছিল
রাই। তার পিছু পিছু ঘুরে সে শিখেছে। তখন বাবা ছিলেন। কী করে নদীয়া থেকেই আনিয়ে দেন
শ্রীখোল। দুটো। একটা বালক রাইয়ের জন্য। আরেকটা রাই যখন বড় হয়ে যাবে, তার জন্য।
বাবা কী করে জেনেছিলেন, রাইয়ের ভাগ্য বাঁধা হয়ে গেল এই শ্রীখোলের সঙ্গে! তখন, যখন
তখন বাবা বলতেন, ‘বাবা এট্টু বাজাইয়া শোনা’। কোনো গান নেই, কিছু না। কেবল শ্রীখোল। সেই বাজনা শুনেই
বাবার চোখে অবিরল নেমে আসত অশ্রু। কৈশোরে দীক্ষা হল। কণ্ঠীধারণ কল রাই। বাবরি চুল
হল। আর পৃথিবী থেকে উবে গেল রাইচাঁদ। এ আরেকজন রাই। সে কেবল নারী হতে চায়। একবার
মাত্র গোপালজীকে দুধ খাইয়ে মরে গেলেও কিছু যায় আসে না। কিন্তু একথা জানেন গোপালজী
আর জানে রাই। পৃথিবী জানে না। কোনো নারীর
কোলে শিশু দেখলে হা-হা করে কোলে তুলে নেয়। লুকিয়ে তার মুখটি চেপে ধরে নিজের অস্পষ্ট স্তনের ওপর।
একপ্রকার পুলক ঘিরে ধরে তখন। একটু পরেই সে মিথ্যা হয়ে যায়। মিথ্যা মনে হয়। ঠাকুর
ঘরে যায় সে, আর একই প্রশ্ন, ‘কবে ঠাকুর, কবে’, কবে আর?’
আজ পূর্ণিমার কাজ ছিল।
লম্বা আসর হল কীর্তনের। বটতলায়। গ্রামের
সকলে এল। বাইরে থেকেও অনেকে এসেছে। কিন্তু কিছুতেই বাজাতে রাজি হল না রাইচাঁদ।
শেষে বাবুলের মা এসে বলে, ‘তুমি না বাজাইলে তো আমার কান্দন আইতো না বাপ। আমি আমার
বাবুলরে তোমার বাজনার তালে তালে হামা দিতে দেখি। বাবুল তো বাজনা অইয়া গেছে।‘ মন
ভিজে গেল রাইয়ের। তুলে নেয় শ্রীখোল। ‘মাথুর হোক’ আদেশ করে সে। দূর বনকর থেকে এসেছে
একটা অতিথি কীর্তনিয়ার দল। আসলে রাইচাঁদের বাজনার ভক্ত দূর দূর জায়গার দলগুলি।
তারা একবার অন্তত রাইকে শুনিয়ে নিতে চায় তাদের কীর্তন। অথবা, তারা ভাবে রাইয়ের সঙ্গে না গাইতে পারলে
গেয়ে কী লাভ।
বটতলার নাটমন্দিরে এখন মাথুর
চলছে। এই দলের মালিক শম্ভু শর্মা। আসলে ব্রাহ্মণ। খোদ নবদ্বীপ থেকে ছেলেকে বিয়ে করিয়ে এনেছেন। বউটির
কী মধুর কণ্ঠ! কী শিক্ষিত। কী উচ্চারণ! প্রথমে গোবিন্দবন্দনা করে শ্লোক বলল ওই
মধুক্ষরা কণ্ঠে। কী ভক্তি! এবার...শ্রীরাধিকা অমঙ্গল ইঙ্গিত দেখতে পাচ্ছেন। তাঁর
দক্ষিণ নয়ন নাচে। কুলক্ষণ। পাখিরা কাঁদছে। ওদিকে যাত্রামন্ত্র গাওয়া হচ্ছে।
শ্রীহরি ছেড়ে যাচ্ছেন। নিশ্চিত। এত সম্ভ্রান্ত গায়কী পেয়ে রাইচাঁদ ভরে ভরে যাচ্ছে।
অক্রূরকে রাধিকা বলছেন, ‘নিয়ো না, নিয়ো না
পরাণবল্লভকে...’ ‘কোথা যাও, কোথা যাও, কোথা যাও হে পরাণ রাখাল, মুখ তুলে চাহ চাহ
চাহ একবার... আবার দেখা হয় না না হয়... পরাণখানি যায় না ছেড়ে... তুমি না বলেছিলে
ব্রজ ছেড়ে যাবে না’। ‘আমি আজ যাব কাল আসব ফিরে, মথুরা নয় বহু দূরে, দাও গো আমার পথ ছেড়ে’ বলে
শ্রীগোবিন্দ আশ্বস্ত করছেন...
আজ রাইচাঁদ এ কী বাজাচ্ছে! এদিকে
মাঝে মাঝে সংস্কৃত শ্লোক বলছে শম্ভু শর্মার পুত্রবধূ এই হল আসল জিনিস। মানুষ
কান্না ভুলে গেল, নাকি কান্না এখন আরো গভীরে চলে গিয়েছে? পালার পর্বে পর্বে পাল্টে
পাল্টে যাচ্ছে রাগ। পাল্টে যাচ্ছে সুর। ভাব। আমাদের রাইচাঁদও কোথা হতে সোনা এনে
জুড়ে দিচ্ছে বাজনায়। আবার কখনো মনে হচ্ছে বাজনায় সে মেখে দিচ্ছে মহার্ঘ চন্দন।
সকলকে অবাক করে দিয়ে বউটি গান থামিয়ে এসে রাইচাঁদের গলায় নিজের পুষ্পমালাটি পরিয়ে
দিল। বিনিময়ে রাই তাকে আলিঙ্গন করে, নমস্কার জানায়। না, মাথা নুইয়ে নয়। বাজিয়ে। তাতে বউটির ভাব আরও
গভীর হল। শ্রীগোবিন্দের রথ চলে গিয়েছে দৃষ্টির বাইরে। এখন আর ধূলাও দেখা যাচ্ছে
না। এখন শ্রীরাধিকা বান্ধবশূন্য হলেন। সখীকে ডেকে বলছেন, ‘এতদিনে বান্ধবশূন্য
হলাম। এখন যাইতে যমুনার জলে তমালের নীচে সে আর জ্বালাবে না। সেই সুমধুর জ্বালাতন
আর কে করবে’?
একমসয় শেষ হল পালা। এবার কাঁদছে সকলে।
মনেহয় বৃক্ষটিও কেঁদে নিয়েছে। তার অযুত পাতায় পাতায় জোছনা। এ আবার আরেক আনন্দ
ছড়িয়ে আছে গাছের পাতায়, পাতায়। একটা অন্যরকম বটবৃক্ষের মতন নাটমন্দিরের মাঝখানে
দাঁড়িয়ে আছে রাইচাঁদ। কাঁপছে। আজকে প্রথমবারের মতন শ্রীবিগ্রহের সামনে অন্যসকল
মানুষকে প্রণাম করল বাবুলের মা। বয়সের ব্যবধান রাখল না। আর ওই সুমধুর সংগীতের
জননী, শম্ভু শর্মার পুত্রবধূ গলবস্ত্র হয়ে পাশে রাখা শ্রীখোলকে প্রণাম করল। কণ্ঠ
হতে বহুমূল্য সোনার হারখানি খুলে শ্রীখোলের উপর রাখল। কৃষ্ণ কৃষ্ণ হে, কৃষ্ণ কেশব
হে... আজকের আসর শেষ হল। সকলে পরস্পরকে আলিঙ্গন করে। আবার, আবার প্রণাম করে।
সাষ্টাঙ্গ হয় যুগল বিগ্রহের সামনে। আর স্থির হয়ে তাকিয়ে থাকে রাই। আজ যেন সে নেই
এইখানে। ভেতর থেকে কে যেন শুষে নিচ্ছে তাকে, কিংবা কী একটা যেন প্রবেশ করছে শরীরে।
আনন্দ? নাকি কী একটা পুলক? একে একে বাড়ির দিকে রওনা হয় সবাই। শম্ভু শর্মার দল একটু
দূরে থাকবে শহরে। তাদের গাড়িও চলে যায়।
একটু এগিয়ে গেলে একটা তমাল
গাছ। প্রাচীন গ্রাম। এখানে কেউ উদ্বাস্তু নয়। মহারাজের আমল থেকে এ গ্রাম বৈষ্ণব।
মণিপুর থেকে মহারাজের কোন এক আত্মীয় এসে
এই গ্রাম প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছেন। কবে কোন সনে কেউ জানে না। এই তমাল তরু সেই লোকের
লাগানো। রাইচাঁদ একা বাড়ি ফেরার সময় তমালকে শাসায়, হয় আজগা, নইলে নাই।
আজ আর ঠাকুরঘরে যায় না রাই।
একবার নিয়মরক্ষার নিদ্রা দিয়ে আসে। কয়েকটা করবী গোটা এনে হামানদিস্তায় ছেঁচে নেয়।
পেতলের সেই ঘটিতে দুধের সঙ্গে মেশায়। আজ হয় হবে, নাহলে বিদায়। শুধু তখন, যখন এ
প্রাণ ছেড়ে যাবে, একবার এসে শিয়রে দাঁড়িও ঠাকুর। ঘটিতে দুধ ধীরে নীলবর্ণ হয়ে
যাচ্ছে। রাইচাঁদ ধূপ জ্বালিয়ে দেয় ঘরে। জানালা খুলে দিলে দূর আকাশের আলো এসে তার
মেঝেতে খেলা করে। একটা কী পাতা বাতাসে নাচছে। তার দোলনের ছায়া এসে ঘরের মেঝেকে আরো
প্রাণবন্ত করে তুলছে। একটু জিরিয়ে নেবে ভাবে রাই। তারপর ওই দুধ খেয়ে শুয়ে পড়বে। যা হোক হবে...
পূর্ণিমার চাঁদ কখন সরে
গিয়েছে। কেমন আধো অন্ধকার হয়েছে ঘর। কোন ফাঁকে ঘুম এসে গেল রাইয়ের। তার মুখের
পেলবতা আরেকটা জোছনা তৈরি করেছে। কেমন একটা হাসি শুয়ে আছে রাইয়ের মুখে। বুকে একটা
চাপ চাপ আরাম। একটু কি ব্যথা? যন্ত্রণা? মাঝে মাঝে কেমন পুলকবেদনার চিহ্ন ফুটে
উঠেছে তার চোখেমুখে। কখনো মুচকি হাসছে।
কখনো ভ্রূ কুঁচকে যাচ্ছে তার। ত্বরিতে উঠে দাঁড়ায়। তার বুক দুটো ভরভরন্ত স্তন।
টনটন করছে। রাই বুঝতে পারে স্তনে দুধ এসেছে। এসে চাপ দিচ্ছে তাকে। তার আবাল্যসাধনা
আজ পূর্ণ হল। ছুটে ঠাকুরঘরে যায়। আজ কপাট লাগাতেও ভুলে গিয়েছিল। অসময়ে নিদ্রা থেকে
তোলে গোপালজীকে। চেপে ধরে তাঁর ঠোঁট ওই সদ্য জাগা স্তনের বোঁটায়। অজ্ঞান হয়ে যায়।
আবার জ্ঞান ফিরে আসে। আবার অজ্ঞান হয়। বারবার সে গোপালজীকে খোঁজে। রুপার তৈরি
গোপালঠাকুর তো দুধ খেতে জানেন না মনে হয়। ওই তো, কে ও? বাবুল, হামা দিয়ে আসছে? সে এসে
স্তনের বোঁটায় মুখ লাগায়? অসহ্য চাপ কমে যাচ্ছে এবার। কী সুখ, কী সুখ! কুট করে
কামড়ে দেয় বাবুল। জ্ঞান ফিরে আসে রাইয়ের। শিয়রের কাছে পেতলের ঘটি। তাতে বিষ হয়ে
যাওয়া দুধ। রাই নেশাগ্রস্তের মতন হাঁটে। উঠোনের এককোণে একটু জোছনা। রাইচাঁদ উপুড়
করে দেয় সেই ঘটি।
প্রকাশিত : উৎসারণ পূজা সংখ্যা, ২০১১
(একটি বই পড়লাম। অ্যামাজনের এফিলিয়েটেড)
প্রকাশিত : উৎসারণ পূজা সংখ্যা, ২০১১
(একটি বই পড়লাম। অ্যামাজনের এফিলিয়েটেড)
এই গরমেও এক শ্বাসে পড়তে হলো।
উত্তরমুছুনঅনেক ধন্যবাদ
মুছুনকি ঘোর!! কি ঘোর!!
মুছুনলেখকের অসাধারণ লেখণি গুণেই সম্ভব হয়েছে এমন...
dramatic
উত্তরমুছুনThanks for reading
মুছুনধন্যবাদ
উত্তরমুছুনঅসাধারণ লেখা।
উত্তরমুছুন