গদ্য অথবা গল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
গদ্য অথবা গল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

বুধবার, ১১ মে, ২০২২

বেনুর সঙ্গে ইডেনবনে


 

বেনুর সঙ্গে ইডেনবনে

অশোক দেব


বেনজির ভুট্টো তো দেখি আমার থেকে লম্বা! কেমন সংকোচ হচ্ছে। নচিকেতা পেছন থেকে এক ঠেলা দিতেই আমি গিয়ে পড়লাম তার বুকে। এ নচিকেতা কিন্তু জীবনমুখী না, এ হল মৃত্যুমুখী নচিকেতা। নিতান্ত বালক। কয়েকদিন থেকে শুনছি পৃথিবীর শেষ । ধ্বংস হয়ে যাবে ইংরাজি সিনেমার ঢঙে। মাত্র চালশে চলছে, কত ফস্টি বাকি, অনেক নস্টিও তো করা হল না। তাই চান্স পেলেই একমনে নচিকেতার ধ্যান করতে লাগলাম। দেবতারা নিশ্চয়ই ব্যস্ত। লবি করতে হলে এ ছেলেটাকে ধরলেই কাজ হবে বলে মনে হল। কী বাঘা বাঘা প্রশ্ন করে ছেলেটা! কে না জানে, বেশি যে প্রশ্ন করে সে আসলে ইমপরটেন্স চায়। এদের পটাতে সুবিধা। তাই হাঁটতে চলতে, উঠতে বসতে শুধু নচিকেতার ধ্যান। বৌ আমার ঢুলুঢুলু চোখ দেখে মনে করে মদ ছেড়ে এখন গাঁজা ধরেছি। মনে মনে বলি, কাঁহা তুম, কাঁহা বেনজির!

    শনি না মঙ্গলবার মনে নেই। সন্ধ্যাবেলা একটা ছেলে এসে কোত্থেকে সামনে দাঁড়াল। স্পাইক করা চুল দেখলে মেজাজ খিঁচড়ে যায়,
অ্যাই তুই কেডা? বলতেই সে প্রশ্ন করল, এ জগতের শেষ হলে কি সৃষ্টি শেষ হয়ে যাবে?

–– ভাই ভাই আমার অন্যায় হইয়া গেছে, তুমি...মানে আপনি নচিকেতা?

–– হুম, বাট ইয়ু ক্যান কল মি নচি, ক্যান্ট ইয়ু?

নচি ফচি কাম নাই, আমি একটু হেই পার যাইতে চাই।

–– কেন?

–– না, মানে...

–– আমি কি জানি না ভেবেছ?

    শালা খালি প্রশ্ন করে কথা বলে। জানলে তো চুকেই গেল। নিয়ে চল। মনে মনে বলি। মুখে ঝোলাই পানসে হাসি।

–– চন্দ্রপুর বাসস্টপ চেন না? সেখানে হেঁটে যেতে পারবে তো? কত অটো আছে না? জোড়সংখ্যার নম্বরের যেকোনও একটাতে উঠতে পারবে?

–– পারব।

–– ওকে। উঠে মনে মনে এই মন্ত্রটা বলতে পারবে না? বলেই কানে কানে একটা মন্ত্র ফুঁকে দিল।

    চন্দ্রপুর বাসস্টপ থেকে ২১১২ নম্বরের অটোতে চেপে, মন্ত্র বলার সঙ্গে সঙ্গে কোত্থেকে একটা ষাঁড় ডেকে উঠল। তারপর কিছু মনে নেই, দেখি আমি এখানে। সামনে বেনজির ভুট্টো, পেছনে নচিকেতা।

    মায়া না কে জানি একটা ক্যালেন্ডার বানিয়েছে। তাতে পৃথিবীর এক্সপায়ারি ডেট ২১ ডিসেম্বর ২০১২। এটা জানতে পেরেই কচিকলাপাতাকাল থেকে ফেনাটিসাইজ করে আসা বেনজিরের সঙ্গে ডেটে যাবার বাসনায় নচিকেতাবন্দনা শেষ পর্যন্ত সাকসেস। কিন্তু টিউবলাইটের মত ফর্সা বেনজির দেখি আমার থেকে লম্বা।

    নচির ধাক্কা খেয়ে আপাতত আমি তার বক্ষে। কী সুন্দর গন্ধ! এত ছিন্নভিন্ন হয়ে যে মারা গেছে কোথাও কোনও চিহ্ন নেই। স্বর্গীয় পার্লারে সব ঠিকঠাক করিয়ে নিয়েছে মনে হয়। একটা পাতলা চুল আমার কানের কাছে সুরসুরি দিতেই চকাম করে তার গালে দিলাম এক চুমু বসিয়ে। ইয়া খুদা কিতনা বদমাশ লেড়কা হায়... হিহি করে বলে উঠল বেনজির। লেড়কা, আমি লেড়কা... বেনু, আমার বেনু। কলার ধরে হেঁচকা টানে সরিয়ে নিল কে? কে আবার, নচিকেতা।

–– বসের সঙ্গে দেখা করবে না? তার আগেই চকাম চকাম শুরু?

–– কে বস? কেডা?

–– ইয়ম ইয়ম, যেতে হবে না?

    ইস, এলাকা যমের, তার সঙ্গে একটু দেখা না করলে চলে? গেলাম। আরে, একে দেখি সঞ্জয় দত্তের মত দেখতে। প্রণাম করলাম। অবাক কাণ্ড, তার চকচকে জুতোয় নিজের মুখ দেখলাম। অবিকল শাহেদ কাপুর।

–– হুম... কবি? কবিতা লেখেন? যমরাজ আমাকে আপনি করে কথা বলছেন, অবাক... কবিতা লিখি তো ...

–– উঁ

–– বলুন তো, আমরা সব গর্বিত বাঞ্চোতের দল, কার কথা? ফরাসি কবি জোয়ান কিলদের লেখা পড়েছেন?

কুঁকুঁ করে একটা আওয়াজ বেরোল আমার কণ্ঠ হতে শুনতে পেলাম

–– ,বাঙ্গাল তো... আচ্ছা, অনন্ত খুচরোজ্জমান খোকার পাল্কিনামা পড়েছেন?

–– কুঁকুঁ...

শালা আঁতেল মইরা যম হইছে দেখি। কবি টবি কিছু না, আঁতেলরা নিজের ছেলেকেও আপনি করে কথা বলে। আমি কী করি! পড়েছি আতান্তরে

–– ছোঁরীয়েঁ নাঁআআআ... বলে আহ্লাদে বাঁচাল বেনজিরই। আমাকে যমের কবল থেকে ছাড়িয়ে স্লো মোশনে ছুটতে লাগল বেনু আমার বেনু। হিন্দু স্বর্গ, মুসলিম স্বর্গ, ইডেন চৌমুহনী, প্যারাডাইসের মোড় পেরিয়ে আমরা চলে এলাম লাভারস পয়েন্টে। সির একাধারে সিন্নি খাওয়াচ্ছে ফরহাদকে। মজনুভাইয়ের পাজামা সেলাই করছে লাইলিদি। আমাদের পাড়ার নুনুদি নিমাইদার প্রেমে আত্মহত্যা করেছিল, তাকে দেখলাম রাজেশ খান্নার সঙ্গে হেঁটে যাচ্ছে। এসব দেখছি আর বেনু আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ক্যায়া হুয়া? তার দিকে তাকাতেই চকচক করে উঠল গোলাপি ক্লিভেজ। তারপর আমরা দেশ পত্রিকার উপন্যাসের মত করলাম। সঙ্গে ইলাস্ট্রেসনের যত মুদ্রা আঁকা থাকে সব সব করলাম আমরা। কোথা দিয়ে কেটে গেল এতগুলি দিন। না ক্ষুধা না তৃষ্ণা। বেনজিরের মত মেয়ে হয় না, প্রধানমন্ত্রী, তা-ও শত্রুদেশের, একটুও দেমাক নেই। শরীরও টানটান জিংলাপোড়া সাপ। বহুজননের ক্লেশ সে পৃথিবীতেই ফেলে রেখে গেছে।

    শুধু একজনকে দেখলেই সে সিঁটকে যায়। পাঠান ড্রেস পরা লোকটাকেই দেখলেই বোঝা যায়, সে আইএসআইয়ের হবে। বেনুর বর তামাক না জর্দা, সেই কি সুপারি দিয়ে পাঠালো? সেদিন আমরা একটা সানন্দামার্কা কাজ করছিলাম, দেখি সে আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে আছে। ছুটে গিয়ে কষালাম এক লাথি। সে আমাকে কী জানি কী করল, আমি সোজা পৃথিবীতে। চারদিক থকথকে কাদায় ভরে আছে। শনিগ্রহের ডিসকভারি চ্যানেল থেকে ছবি তুলতে এসেছে একটা টিম। একটা পোকাটাইপের লোক সিলেটি অ্যাকসেন্টে ইংরেজি বলছে। ক্যামেরার দিকে কী একটা চকচকে জিনিস দেখিয়ে সে বলছে, ধ্বংসের আগে পৃথিবীর মানুষ কত সুন্দর অলঙ্কার বানাতে পারত। একটু কাছে গিয়ে দেখলাম একটা নাকছাবি। চোদ্দতম অ্যানিভারসারিতে বৌকে এটা দিয়েছিলাম।
----------------------------------------------------------------------------------

[ ২০১২ সালে তাল উঠল, ২১ ডিসেম্বর পৃথিবী ধ্বংস হবে। সেই নিয়ে ক্ষেপচুরিয়াসে প্রকাশিত। ছবিটি দেশ পত্রিকার কোনো একটি সংখ্যা থেকে নেওয়া ] 

 

বৃহস্পতিবার, ৫ মে, ২০২২

দংশনজাতক

অশোক দেব

দংশনজাতক


এক ।

বন্ধুত্বের জন্য জন্মান্ধ শ্রেষ্ঠ। জোড়ামুন সেকথা জীবন দিয়ে বুঝেছে। ললিতদা জন্মান্ধ। এগ্রিকালচারে চাকরি করে। কী চাকরি কে জানে। শোভা বৌদি হাত ধরে ধরে তাকে নিয়ে যায়।নিয়ে আসে। জোড়ামুন আসে রাতে। দামি হুইস্কি আনে। মাংস। শোভাবৌদি দুরকমের মাংস রান্না করে। চাট আর ভাতের সঙ্গে খাবার জন্য আলাদা।গোদকও থাকে। যেদিন আসে, জোড়ামুন এখানেই খেয়ে যায়। কোনো কোনোদিন যায়ও না। এদের রান্নাঘরে একটা ছোটো বিছানা আছে, শুয়ে পড়ে।

    মাতাল হলে জন্মান্ধ চক্ষুষ্মান হয়ে যায়। ললিতভাই ওঠে, কেমন নিজের গেলাস, ওর গেলাস তোলে, মাংসের প্লেট নেয়, তুলে রাখে। একটু জল ছিটে দেয়। বারান্দায় ছোটো একটা ঠাকুরঘর। উঠে গিয়ে ঠিক একতারাটা আনে। গান গায়। কত গান যে সে জানে! শোভা বৌদি এখন ঠাকুরঘরে চিনচিনে গলায় কীর্তন করছে।

   ললিতভাই

   কন

   আজকে গান শুনতাম না

   আইচ্ছা, গাইতাম না, থাক

   ললিতভাই

   কন

   মদ খাইলে আপনে দেখতে পান?

   না রে ভাই, চোখে কিছু দেখি না। আন্ধার দিয়া দেখি

   আমি কেমুন দেখতে?

   কইতাম, কই?

   কন, চোখ বুলিয়ে শোভা বউদি কোথায় আছে একটু দেখে নেয় জোড়ামুন।

   আপনে গৌরাঙ্গের মতন। কেবল বর্ণডা কালা, শ্রীঠাকুরের মতন। উচা নাক, চোখ ভাসাভাসা

জোড়ামুন বাইরে চলে আসে। ললিতভাই টের পায় না। এখনো তার রূপের বর্ণনা করছে। আর থাকতে ভাল লাগছে না এখানে। খেতের মাঝখান দিয়ে একটা শর্টকাট আছে। জোড়ামুন সেটা ধরে। বাইকটা থাকুক। পরে এসে নেওয়া যাবে।

দুই।

জোড়ামুন আসলে মরণ।দিদি পেটে এলে মা স্বপ্ন দেখেছিলেন, লক্ষ্মী আসছে। তারপরে যদি কেউ আসে, তাহলে সেসব হবে রাক্ষস। অপরূপ এক বালিকার স্বপ্ন মা দেখেছিলেন। বাবাকে বলেন। শুনে বাবাও সেই লক্ষ্মীকে দেখতে পান। একদিন সত্যই দিদি এল। একেবারে যেমন স্বপ্ন। তিনবছর পর, কে জানে কার ভুলে মায়ের পেটে উদ্গার নিয়ে চলে এল মরণ। পাহাড়ি লতাপাতা, হোমিওপ্যাথি কিছুতেই কিছু হল ন।মরণ মরল না। শেষে বিষ্ণু ডাক্তারের কাছে গিয়েও কাজ হল না। মায়ের রক্ত কম ছিল।জন্মের আগে মরণকে মারা গেল না। মরণকে আসতেই হল।কিন্তু এসবের ধাক্কায় মরণ কেমন বদলে গেল ভেতর ভেতর। জন্মাতে গিয়েও মাকে নিদারুণ কষ্ট দিয়েছে। বিরাট হয়ে গিয়েছিল সে।বের করে আনতে গিয়ে আঁকশি দিয়ে টানল ডাক্তার।ফরসেপ না কী যেন। বেরিয়ে এলে দেখা গেল,মরণের মাথার পেছনে উঁচু। প্রায় আরেকটি মাথা। মোটা নাক। যত বয়স হয়েছে, সেটি হাড় ছেড়ে এসে লতপতে হয়ে ঝুলতে শুরু করেছে।বাঁদিকের কান গালের সঙ্গে মিশে গিয়েছে। নীচে ঠোঁট ভারি, সারা বাল্যকাল সে এটা সামলাতে পারেনি। লালা ঝরত। এই জ্বালার নাম বাবা মা রেখেছিল, মরণ। একটু বড়ো হতেই সবাই ডাকে জোড়ামুণ্ড।ওর তো দুটো মাথা। শেষে জোড়ামুণ্ড হয়ে যায় জোড়ামুন। জোড়ামুন ভুলেই গিয়েছে তার নাম মরণ।একেবারে ছোটোবেলায় লোকে তাকে দেখে বাবা মায়ের দিকে জিজ্ঞাসা নিয়ে তাকাত।

   ফোরসেপ বেবি।

    খেতের মাঝখান দিয়ে হাঁটছিল জোড়ামুন। নেশা হয়েছে। টলছে।কিছুতেই আল থেকে নেমে খেতে পা ফেলা যাবে না। সবাই মারে। একটু এদিক ওদিক হলেই জোড়ামুনকে লোকে মারে। বাবাও মারতেন, মা মারতেন, দিদিও। ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠা বারণ ছিল। উঠলেও বাইরে বেরোনো নিষেধ। জোড়ামুন, তার বেড়ার ঘরে বসে থাকে। ফাঁক দিয়ে ধীরে ধীরে আলো আসে। সূর্যোদয় হয়। প্রথমে কেমন নরম শ্যমলা আলো আসে। বোঝে এটা ভোর। ধীরে ধীরে তা একটু লালাভ হয়। পরে হলদেটে হয়ে যখন সাদা হয়ে যায়, তখন জোড়ামুন ঘরের বাইরে যায়। ততক্ষণ প্রস্রাবের বেগ পেলেও চেপে রাখে। ঘুম থেকে উঠে তাকে কেউ দেখে ফেললে বিপদ। যে দেখে তার দিন নষ্ট হয়ে যায়। একদিন বাবার দিন নষ্ট হয়েছিল, একদিন মায়ের সোনার কানের হারিয়ে গিয়েছিল তাকে দেখে ফেলায়।খুব মার খেয়েছে।দিদির পরীক্ষা খারাপ হলেও মার খেত। কেন যে মিছেকথা বলত দিদিটা। রক্ত না এলে কিংবা ফিট না হয়ে গেলে মার বন্ধ হয় না। জোড়ামুন ইচ্ছে করে ফিট হয়ে যেতে জানে। সবাই ভাবে, এটাও বুঝি সে জন্ম থেকে এনেছে।আসলে জন্ম থেকে কিছুই নিয়ে আসতে পারেনি জোড়ামুন।

    সেবার দিদিকে দেখতে আসবে। জোড়ামুন দিদিকে সরাসরি কখনো দেখেনি। কিন্তু দিদিকে সে খুব দেখতে চাইত। ছোটো থেকে শুনে এসেছে সে লক্ষ্মী।কিন্তু কারো দিকে সরাসরি তাকালেই মারে সবাই। কিছু না হোক একটা চড় তো আছেই। সকালে অবশ্য সে বেড়ার ফাঁক দিয়ে সবাইকে দেখে। তার ঘরের উলটো দিকে বাবার দোতলা বাড়ি। দিদি ওপরে থাকে, বাবাও। মা নীচে থাকে। সবাই একে একে ঘুম থেকে ওঠে। বাবা সকালে সূর্যপ্রণাম করেন। জোড়ামুন বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখে, দিদি কী একটা লম্বা মতন আসন পাকা উঠোনে পেতে নানারকম ব্যায়াম করে। জোড়ামুন দেখে। সেই দিদিকে আজ দেখতে আসবে। বিকেলে। জোড়ামুন খুশি। মামারা আসেন ভাইফোঁটার দিনে। যাবার সময় জোড়ামুনকে ডাকেন। জোড়ামুন মাথা নিচু করে নিজের ঘরটির সামনে দাঁড়ায়। মামার,মামাত ভাইয়েদের জামাকাপড় দিয়ে যায় তারা। সেখান থেকে লাল একটাকে বেছেছে। আজ দিদিকে দেখতে আসবে। কিন্তু সকালবেলাতেই জোড়ামুনকে দুবার ফিট হতে হল। লাল জামা পরে সে বেরিয়ে গিয়েছিল। দিদিকে দেখতে আসবে। লক্ষ্মীর বিয়ে,বর না জানি কী সুন্দর হবে। জোড়ামুন বেরিয়েছিল।এবার মার খেয়ে জোড়ামুন চুপে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। পালাল।

    বৃষ্টি হচ্ছে। এখন শ্রাবণ মাস। জোড়ামুন খেতের আল ধরে হাঁটে। নেশার মধ্যে ভিজতে ভাল। ফিক করে হেসে ফেলে সে। বাড়ি থেকে পালিয়ে সে আবিষ্কার করল, তার দাম আছে। বাসগাড়ি ভাড়া নেয় না। খিদে পেলে খাবারের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেই হয়। খাবার দেয়। কিন্তু ওর তো শরীরটি খাসা। যেন পাথরের তৈরি। জনার্দন দারোগা তাই দেখেই ওকে নিয়ে এসেছে। দারোগার অনেক জমি, রাবার বাগান। গোরু। শখের কৃষক এই জনার্দন দারোগা।বাপঠাকুর্দার রেখে যাওয়া বিশাল সম্পত্তি। জোড়ামুন একমাসেই সব শিখে ফেলে। রাবার গাছ কাটা, রস নেওয়া, সেসবের পাতি বানানো, শুকানো সব জানে। পাঁচজনের কাজ একা করে দেয় সে। জনার্দন দারোগা তাকে রেখেই দেন। খেতেও দেন ডাঁট করে।

ভিজতে ভিজতে এসে পেছন দিয়ে বাড়িতে ঢোকে জোড়ামুন।ললিতভাই আর বৌদি হয়তো অবাক হবে। হোক।পুকুর পাড়। তারপর অনেকটা খালি জমি। ভেজা ভেজা। মোস্তাক গাছের জঙ্গল। এই গাছের বেত দিয়ে শীতলপাটি হয়। মাঝেমাঝে জোড়ামুনও পাটি বোনে। শখ করে।মন ভাল থাকে। এখানে এসে ছোটো একটা ঢিবি।তার সামনে নত হয়ে প্রণাম করে জোড়ামুন। এখানে থাকে রিমা আর ঝিমা।

তিন।

সব দারোগা কিন্তু দারোগা নয়।জনার্দন দারোগা আসলে কী চাকরি করতেন কেউ জানে না। তবে গুলি লেগে ডান পা খোঁড়া হয়েছে। জনার্দনের মেয়ের নাম বিপাশা। বিয়াস।

    তখন যুদ্ধ হবে হবে। ১৯৬৫। জনার্দনকে যেতে হবে পাঞ্জাব।গেল। পরিবার নিয়ে যাবার নিয়ম নেই। কিন্তু জনার্দনের বউ তখন পোয়াতি। দেখার কেউ নেই। তাই নিয়ে যাওয়া গেল। ফাজিলকাতে পোস্টিং। শুকনো একটা জায়গা। প্রচণ্ড গরম। শীতকালে মারমার শীত। বিয়াস নদীটি কাণ্ড করে। এই পাকিস্তানে ঢুকে যায়, আবার বাঁক নিয়ে ইন্ডিয়াতে চলে আসে। সেখানেই কন্যার জন্ম। নাম তাই বিপাশা।দিনের পর দিন কোথায় থাকে জনার্দন বউ জানেই না। সবই হল পরে পরে, নিজের বলতে স্বামীটি ছিল। যত্ন করবে বলে এখানে এনে নিজেই বেপাত্তা।এইসব বিত্তান্ত জনার্দনই বলে জোড়ামুনকে। জোড়ামুন ঝিমুতে ঝিমুতে শোনে। কিছু বোঝে কিছু বোঝে না। তবু বাবু এসব বারবার বলে। কেন কে জানে।

সেখানেই বড়ো হচ্ছিল বিপাশা। বিয়াস। ৬৫ গেল। তারপরই শুরু হয়ে গেল একাত্তরের তোড়জোড়। বিপাশা তখন একটু একটু বুঝতে পারে। বাবা যে আর্মি বা পুলিশ নয়, সেটা বোঝে।হিন্দি বলতে পারে, ইংরেজি বলে ফটফট, পাঞ্জাবি তো যেন মেয়ের মাতৃভাষা। আর মেজাজ হল মেজরের মতন। একাত্তর গেল। বাবা কিছুদিন বাড়িতে। ওমা আবার হারিয়ে গেল। তখন কী যেন, ভিন্দ্রাঁবালে হচ্ছিল। কী যেন খালিস্তান।বাবা আসেন মাঝেমাঝে। মেয়েকে আড়াল করার চেষ্টা করলেও, বিয়াস ঠিক দেখে বাবা পিস্তল লুকিয়ে রাখে। বাবা সেটাকে পিস্তল বলে না, বলে হাতিয়ার। মেয়েটিও যে দিনদিন হাতিয়ার হয়ে গিয়েছে, জনার্দন দারোগা সেটা বুঝতে পারছিলেন?

    তখন সারা দেশেই যেন দাঙ্গা। জনার্দন ব্যস্ত।প্রায় অজান্তেই স্বর্ণমন্দিরে সেনা গেল।সেখানে ছিলেন জনার্দন? বিপাশা জানে, বাবা ছিল। সেখানেই পায়ে গুলি লাগে। তারপরেই চাকরি শেষ হল। বিপাশার পরীক্ষার জন্য ৮৭ সাল পর্যন্ত থাকতে হল ফাজিলকাতে।আর ছিল গান। ফাজিল খাঁ ওয়াট্টুর বংশের এক উস্তাদের কাছে গান শিখত বিয়াস। ছুটির দিনে বাবা মেয়ে চলে যেত সাদিকি গ্রামে। সেখানে ভারত-পাক জয়েন্ট চেকপোস্ট। পতাকা নামানোর সময় দুই দেশের সেনা কী বীরত্ব দেখায়। বিপাশা মোটরবাইকে করে বাবাকে নিয়ে এখানে আসে। দেখে।রক্ত গরম হয়। বাবা,ফির কব জং হোগা?

   যুদ্ধ জিনিসটা ভালা না, মা

বিপাশা বাবাকে একটা ঘুঁষি দেয়। সেই থেকে মেয়ের সঙ্গেই জনার্দনের যুদ্ধ। এবং পরাস্ত হতে তার ভাল লাগে।

চার।

   চল

   কই, দিদি?

   রাখ তোর দিদি, তোরে বিয়া করুম।

ঝনঝন করে ওঠে জোড়ামুনের পৃথিবী। সে জানে বিয়াসদিদি যা বলে তা করে। কিন্তু অত সুন্দর সুমিত বসুঠাকুর? সুমিতদাদা সুন্দর। সত্যই গৌরাঙ্গ। ডাক্তারি পড়া শেষ করেছে। কোথায় যেন একটা চাকরি পেল। বিয়াসদিদি সেখানে যেতে দিতে রাজি নয়। সুমিতদাদা যাবেই। বিয়াস দিদি জনার্দন দারোগার মেয়ে। অঢেল টাকা। সুমিতদাদাকে নার্সিং হোম খুলতে বলে বাবার টাকায়। সে রাজি নয়। এটুকুই জানে জোড়ামুন। বাকি কী হল?

   ওঠ গান্ডু, বাত নেয়ি সমঝতা?

   দিদি

   আরেকবার দিদি ডাকবি তোর একদিন কি আমার একদিন

লুঙ্গি পরেই মোটরবাইকের পেছনে বসে পড়ে জোড়ামুন।প্রথমে মেয়েদের মতন একদিকে পা দিয়ে বসেছিল। একটা চড় খেয়ে দুদিকে পা রেখে বসে আর ঘামে।একটু যেতেই, কেন যেন, এখন নিজেকে মরণ মরণ লাগছে। সোজা শহরে, সেখান থেকে পাজামা পাঞ্জাবি। তারপরেই একটা কী মন্দিরে বিয়ে। একটাই মন্দির আছে এখানে বাকি সব খালিস্তানিরা ভেঙেছে।

   বাবা, বাবা

ছুটে বেরিয়ে আসেন জনার্দন দারোগা

   তারে বিয়া করছি

একটু থমকে যান জনার্দন। তারপরেই মারতে শুরু করেন জোড়ামুনকে। জোড়ামুন ঠিক করে আজ কিছুতেই ফিট হবে না। মার খাবে। মাইয়ার কী খেয়াল হইল, বিয়া করল, এখন বাপে মারে। মারতে মারতে মাইরা লাক। মরণ ঠিক করে, আজ সে মরে যাবে।আর একটা কিছু করবা, খুব খারাপ হইব, বাবাকে সাবধান করে বিয়াস। অত মার খায় জোড়ামুন, কোনোদিন কাঁদে না। এইমাত্র সে কান্না কী জিনিস বুঝতে পারছে। তবু মাটি থেকে ওঠে না, যদি আবার মারবার ইচ্ছা হয় জনার্দনের।

   তোর সুমিতের কী হইল মা? এইডা একটা কাণ্ড করলি?

   তোমার সুমিতের মা কইয়া দিছে এই বিয়া হইত না, তারা মালখাঁনগরের বসুঠাকুর। উচা বংশের মাইয়া লাগে।লাথি মারি তারে। আমি ঠিকই করছি।

রণপাগল মেয়ের কাছে এবারেও হার মানেন জনার্দন।

পাঁচ।

অত অত রাবার বাগান,এই অঢেল সম্পত্তি এখন বিয়াসের।লোকে জোড়ামুনকেও মালিক ভাবে? লেবাররা কেমন সমীহ করে। বেচাবিক্রির টাকাও তার হাতে দেয়। একটি কুটোও নষ্ট হতে দেয় না সে। প্রথমে জনার্দন গেলেন, তার তিনমাস পরেই বিয়াসের মা। কারোই শ্রাদ্ধশান্তি হয়নি। বিয়াসের মানা।

খুব গাছপালার শখ এই বিপাশার। সারা বাড়িতে গাছ।যেন একটা জঙ্গল। কত কত ফুল।জোড়ামুনেরও ভাল লাগে। এখানে ভোরে উঠতে মানা নেই।বরং যত রাত থাকতে ওঠা যায়, তত কাজের লাভ। জোড়ামুন ওঠে।সবাইকে কাজে পাঠিয়ে বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখে। বিয়াসের কোন গাছের কী লাগবে ভাল করে দেখে নিয়ে ব্যবস্থা করে ভোরেভোরেই। দূর দূর থেকে নানারকম গাছের চারা আনে। বিয়াস সেসব লাগায় না। যেমনি আনে, তেমনি মরে যায়। প্রথম প্রথম কেমন লাগত। এখন লাগে না।তবু আনে।

    এখানকার ছেলেরা জোড়ামুনকে আরেকটা নাম দিয়েছিল। ডাবল ইঞ্জিন। এরাই ওকে ধরে ধরে নিয়ে যেত। মদ খাইয়ে জানতে চাইত, বিয়াসের শরীর, তার সবকিছু। ডাবল ঈঞ্জিন কেবল মদ খায়,মিটিমিটি হাসে।মদটা সে শিখে ফেলেছে বেশ। কেউ এদিকে মারে,কেউ তার দ্বিতীয় মাথাটা রগড়ে দেয়। ডাবল ঈঞ্জিন কাউকে কিছু বলে না। খুব নেশা হয়ে গেলে গেলাস ভাঙে। সবাই জানে তার গায়ে অসুরের শক্তি। সরে যায়। ডাবল ইঞ্জিন বাড়ি যায় না। আরেকটু মদ কিনে জন্মান্ধ ললিতের বাড়ি যায়।

    ওই ছেলেদের আসরেই একদিন সে ছবিগুলো দেখেছিল। সুমিত আর বিয়াসের বিয়ের ছবি। অনেক অনেক ছবি। ডাবল ইঞ্জিন সেসব দেখে আর ভাবে, কী সুন্দর এই বিপাশা। বিয়াস। সকালে বেড়ার ফাঁক দিয়ে আসা আলোর মতন। তাকিয়ে দেখে, কী সুন্দর মানিয়েছে দুজনকে। এটা কি খেলার বিয়ে? কেন যে সবটা হল না।

     বিয়াস কী পাশ জোড়ামুন জানে না।কী সুন্দর গান গায়। জোড়ামুন ওঘর থেকে শোনে। বিয়ের পরেপরেই বিয়াসের আরো পড়াশুনা বেড়ে গেল। কী কী পাশ দিয়ে যেন চাকরি হল। জোড়ামুন বোঝে না অত যার টাকা, সে কেন এসব করে। বাড়িতে গুচ্ছের বেড়ালকুকুর। ওসবের সঙ্গেই সময় কাটে বিয়াসের।বাগান আছে।আর আসত অনেক ছেলেমেয়ে। গান শিখতে কেউ, কেউ পড়া করতে।জোড়ামুন বুঝতে পারে। বিয়াস নিজেকেই ভুলে থাকতে চাইত। এখন কেউ আসে না।গাড়ি আসে, অফিস যায়। তবু সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে জোড়ামুনের

   আয়

রাত। জোড়ামুন বিয়ায়সের ঘরে যেত। ওই অপার শুষ্কতার মধ্যে যাওয়া আসা করে চলে আসত ।স্পর্শহীন, আনন্দহীন, মারের থেকেও বেশি যন্ত্রণার ছিল এই কাজটা। কেমন যেন কান্না পেত জোড়ামুনের। ও চলে এলেই বিয়াস চান করতে যেত। বমি করার শব্দও শুনতে পেত। একদিন ছেলে হল।

ছয়।

ছেলের মার খেতে ভাল লাগে জোড়ামুনের। অনেক বড়ো হয়েছে। ছেলে হবার পরেপরেই এই ঘরে চালান হয়ে যায় জোড়ামুন। এখানেই কে যেন খাবার দিয়ে যায়। জোড়ামুন ললিতদাদার বাড়ি থেকে খেয়েদেয়ে আসে। ঘরে এসেও মদ খায়। টলে। আর তখুনি তার রাগ চাপে। আমি শালা চেয়েছিলাম জন্ম নিতে? আমি কি কারো কাছে কিছু চাই? দাঁড়িয়ে থাকলে খাবার দেয় দোকানদার।এখানে কে রাখে খাবার, ছাতামাথা? প্লেট ছুঁড়ে মারে। যা-কিছু সামান্য আসবাব, ভাঙাভাঙি করে। আর কান পেতে শোনে কখন ছেলে আসবে। ওর শব্দ শুনলেই উৎপাত বাড়িয়ে দেয়। ছেলে এসে সোজা মারতে শুরু করে। জোড়ামুনের ভাল লাগে। একদম বাবার মতন মারে ছেলেটা। বাবাকে মনে পড়ে যায়। লতপতে নাকে মারে, গালের সঙ্গে মিশে থাকা কানে মারে, চোখের মধ্যে পরপর মারে। জোড়ামুনের বুক ভরে যায়। আর উৎকর্ণ থাকে, কখন বিয়াস আসবে।

   থামো, ঘরে এসো

ছেলে চলে যায়।

সাত।

সকাল।

বিয়াস ডাকে, আয়

সকালে মারবে না হয়তো। ঘরে যায় জোড়ামুন।

   পালক ডাক্তারির চান্স পাইছে

   পালক কেডা? বলেই বুঝতে পারে ভুল হয়ে গেল। বিয়াসের ছেলের নাম পালক।

   কালকে তারে দিয়া আমু, আমি চণ্ডীগড় যামু। তোর এয়ারপোর্ট অব্দি যাইতে হইব। অনেক মালপত্র।

    আর শোন, আগরতলার জমিটা খালি করতে কইবি। নার্সিং হোম হইব। আমি আইয়া সব ঠিক করুম।  

আট ।

এখানে পুকুর। আর এই জমিটা ভেজা ভেজা। অনেক মোস্তাক গাছ। সন্ধ্যা। এই ঢিবিতে থাকে রিমা আর ঝিমা। কেউটে। সবাই বলে একটাই। বারবার দেখা যায়, তাই দুটো মনেহয়। জোড়ামুন জানে দুজন। ও শিবুর ফার্ম থেকে ছোটো ছোটো মুরগির বাচ্চা আনে। এখানে গর্তের সামনে বেঁধে দেয়।সকালে দেয়, সন্ধ্যায় দেয়। একটু পরেই মুরগির বাচ্চা হারিয়ে যায়। রিমাঝিমা, আমার পোলাডা ডাক্তার হইছে। আমারও পোলা, আবার ডাক্তার! শুনছস? নার্সিং হোম করব। আমি বুড়া হমু রোগ হইব। পোলা আর মারত না, চিকিচ্চা করব।কালকে যাইব পড়তে। বিয়াসদিদি দিয়া আইব । কই জানি চণ্ডীমার কাছে। ফিরা আইলে দিদি একলা হইব।আমরা তখন জামাই বউ হমু।

শ্রাবণ শেষ হল। রিমাঝিমার বাচ্চা হয়েছে মনেহয়। ওদের কেউই কাণ্ডটা করেছে।রিমাঝিমা কেউই এমন করবে না, জোড়ামুনের পা থেকে সোজা উপরে উঠে যাচ্ছে একটা বেদনা।জোড়ামুন মাটিতে পড়ে যায়। ও ফিট হতে জানে বটে, কিন্তু মুখে গ্যাঁজলা তো তোলে না। 

 

__________________________
[প্রকাশিত, 'পরিচয়' ১৪২৮ শারদ সংখ্যা] 

শুক্রবার, ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

মনভুম

 




মনভূম
অশোক দেব

 

বাজারের ব্যাগে করে টাকা! লোকটা কী অদ্ভুত আর নির্বিকার। সাদা চেক চেক লুঙ্গি। পাঞ্জাবির বুক খোলা, সাদা, চঞ্চল রোমরাজি, একটা ফিনফিনে কিন্তু ভারি হার। সোনার। কোলের ওপরে ব্যাগটা। নিতান্ত সাধারণ বাজার করবার ব্যাগ। মিহি ফাঁকগুলো দিয়ে দেখা যাচ্ছে লাল লাল নোট। বাণ্ডিল, বাণ্ডিল।সব দুহাজারের নোট! ব্যাগের ওপর বাম হাতটি রাখা। হাতের রোম আবার কালো। আঙুলে একটা কী জানি কিসের আঙটি। বুকে ঝোলানো চশমা, দুলছে। সোনার ফ্রেম হবে। লোকটা মাড়ওয়ারি? না-ও হতে পারে। লুঙ্গি পরা তো। ব্যবসায়ী? টাকা কোনো ব্যাপার না? কিছুতেই ওর দিকে তাকানো যাবে না। তাকানো যাবে না ওই টাকার দিকেও।নিজেকে বলে অনি। কিন্তু এ তো নাক ডাকছে। পোষা ভুঁড়িটা শ্বাসের সঙ্গে ফুলছে। চুপসে যাচ্ছে। ফুলে উঠবার সময় সোজা ফুলে ওঠে। দুমড়ে যাবার সময় দুবার কাঁপে।

ওদিকে জানালা। এ বাসটা এসি। এখনও কয়েকটা চলে।আগরতলা-গৌহাটি। ট্রেনে যাওয়া যেত। অনি গেল না।বাসই ওর জন্য ঠিক, ভেবেছে ও। জানালার কাচটা ফিক্সড। আগের মতন নামিয়ে বাইরের বাতাস নেওয়া যায় না এই বাসে। পর্দা লাগানো। অত দামি বাস, অথচ পর্দাগুলো বাংলাবাজারের। অনি এটাকে একটু তুলে দিল। আবার পড়ে যায়। হাতে লাগছে। কাপড়টাতে শীত মেশানো, তবুও এর একটা নিজস্ব উত্তাপ আছে। সেটাই হাতে লাগছে। একসময়  একটু সরিয়ে জানালার বাইরে তাকানো গেল। অচেনা সব গাছপালা,বাড়িঘর নেই। রাস্তাটা দারুণ মসৃণ। দূরে মাঠ। লোকে কাজ সেরে ফিরে যাচ্ছে। একটা পাওয়ার টিলারকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে একটা কাদামাখা মানুষ। দূরে। কিন্তু গাড়িটা অত ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে কেন? সাঁই সাঁই করে পেছনে চলে যাচ্ছে গাছপালা

সন্ধ্যা হল। কেমন একটা মায়াবী আলো জ্বলেছে। বাইরে ঘোর অন্ধকার। এখন পাহাড়ি রাস্তা। জানালার কাচের গায়ে বিন্দু বিন্দু জল। ঝিরঝির বৃষ্টি হচ্ছে। লোকটা উঠে গিয়ে আবার ফিরেছে। ওই ব্যাগটা সিটে রেখেই গিয়েছিল। একটু আগে যে এক জায়গায় দাঁড়ালো, তখনই কেবল ওই ব্যাগ নিয়ে নেমেছিল। আরেকটা ব্যাগের মধ্যে এই ব্যাগটাকে ঢুকিয়ে নিয়েছিল তখন। কিন্তু থলেটাকে নিল এমনভাবে যেন, বাজার থেকে মাছটাছ কিনে ফিরছে। এখানে একটু চা খাওয়া হল। হাল্কা রুটি আর মটরের ডাল। অনি বহুদিন পর সিগারেট খেয়েছে। লোকটা হাসিমুখে অফার করল। নীরবে। অনিও হাসল।পকেটে হাত দিয়ে দেশলাইটা ছুঁতেই ওর মুখের সামনে একটা টুংটাং আওয়াজ। বেশ সুরেলা।লোকটা লাইটার এগিয়ে দিল। কত দামি হবে এটা? বিদেশি? লোকটা চোখ দিয়ে বলল সিগারেট ধরিয়ে নিতে। অনি ধরাল। আজকে ঠিকই করেছিল কোথাও বসে একটা সিগারেট খাবে। তাই পকেটে দেশলাই নিয়েছিল। কতদিন সিগারেট খায় না। যাক,এই লোকের বদান্যে কিনতে হল না। এখন আবার ঘুমোচ্ছে, আবার সেই নাকডাকা। কোলে ব্যাগ। এখনও সাদা আরেকটা ব্যাগের মধ্যে ঢোকানোই রয়েছে।

কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে এসেছে অনিন্দ্য। গৃহত্যাগ। সোজা হিমালয়। পকেটে কিছু টাকা আর কার্ডস। আর ভালো লাগে না এই খিটিমিটি। পাঁচ বছর হয়ে গেল বিয়ের। আজ বিবাহবার্ষিকী। আজই গাড়ি কিনতে হবে। গত ছমাস ধরে এই এক চাপ। বাড়িঘর কিছু করেনি অনি।বাবার আমলের বাড়িটাই ঠিকঠাক করে আছে, বেশ। নেই গ্যারাজ, নেই প্রশস্ত রাস্তা।সরু গলির ভেতরে একতলা পুরনো বাড়ি।তাতে  আবার গাড়ি? বিবাহবার্ষিকী এলেই প্রতিবছর কতকত টাকা বেরিয়ে যায়। পরীক্ষার পর পরীক্ষা দিয়ে অনিন্দ্য আজ এই জায়গায় এসেছে। ব্যাঙ্কে খাটতেও তার ভালো লাগে। চাইলেই দারুণ একটা বাড়ি করতে পারে। গাড়ি কিনতে পারে। কিছুই করেনি অনি।  সে কৃষক হতে চায়। স্বপ্ন দেখে। সন্তানের প্ল্যানও করল না তাই। কেবল জমি কিনছে। কিনে কিনে বাড়িয়ে চলেছে। আজকাল খালি জমি পাওয়া কঠিন। পুরোটা রাজ্যেই রাবার গাছ।সবাই রাবারের বন তৈরি করছে। এই জমিটা বিশাল। মালিক বাংলাদেশী। এখানে একজন আত্মীয়ার নামে কেনা। তিনি থাকেন কলকাতায়। প্রতিবার একটু করে জমি কেনে অনি। আর ওই মহিলার বায়নাক্কা সহ্য করে। আসা যাওয়ার প্লেনভাড়া, হোটেল, উপহার অনি সহ্য করে। এই হল একটা টিলা। দক্ষিণ দিকটা খোলা। অনেকদূর অব্দি খোলা। অনি ছুটি পেলেই এখানে আসে। মাটির একটা ঘর বানানো হয়েছে। তাতে সব সুবিধা। দক্ষিণে গোল করে একটা পুকুর করেছে। পুকুর কাটায় উঠে আসা মাটিকে নানারকম ট্রিটমেন্ট করা হল। সিজন করা হল ঘর বানাতে। এই ঘর এখনও এদিকের লোকজন বানাতে শেখেনি কেউ। রুরাল ডেভেলপমেন্ট নিয়ে কাজ করে একটা এনজিও আছে।  গৌহাটি বেসড। ওদের কন্ট্রাক্ট দিয়েছিল অনি। ওরা এসে করে দিল। এর চেয়ে ইট কংক্রিটের করলে হয়তো খরচ কম পড়ত ।অনি মাটির ঘরই চেয়েছে। আর কী খাসা বানিয়েছে এরা। শীতে গরম, গরমে ঠান্ডা। আর কেমন একটা গন্ধ। গৃহপূজার দিনে স্বাতীকে এনেছিল,অনেক সাধ্যসাধনা করে। স্বাতী এসবকে পাগলামিই মনে করে। গোবরের তাল, গোহাল, পুকুরের হাঁস সবেতেই তার ঘেন্না লাগে। অথচ ঘরটির বারান্দায় ঝোলানো চেয়ারে বসে যখন দূর দক্ষিণের দিকে তাকায়, অনি কী যেন দেখতে পায়।একটা স্বপ্নকে বড়ো হতে দেখে। পার্মাকালচার করবে সে। একটা অরণ্য নির্মাণ করবে। জগতের যত পোকা, পিঁপড়ে, সাপ, প্রজাপতি সবার জন্য একটু একটু আবাস করে দেবে।বেঁচে থাকতে হলে যা যা দরকার, কিছুই কিনবে না। বাঁচাটাকে কেবল জীবনের প্রাচুর্যে ভরিয়ে তুলবে। অন্য আর কি প্রাচুর্য চাই? এরা কী সুন্দর ডিজাইন করে দিয়ে গেল।চুক্তিটাই এমন। সতীশ দত্ত নামে এক অসমীয়া যুবক এনজিওটার চেয়ারম্যান। ছেলেটা শিল্পী। কেবল স্বপ্ন দেখে। কাজের সময়ে কিছুর অভাব রাখে না। চাঁদ দেখার জন্য, সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত দেখবার জন্যও ছোটো ছোটো ঢিবি তৈরি করেছে। সবগুলোতেই আলাদা আলাদা কাঠের পাটাতন, চেয়ার বাহারি টেবিল। এখানে এলে অনিন্দ্য কেমন হয়ে যায়।নিজেকে মানুষ মনেহয়।বাকি সময়টাতে মনেহয় যন্ত্র। এখানে এলেই সে আপনি গুনগুন করে। আর নারুদের পরিবারটাও দারুণ। এরা কত খাটতে পারে, আর কী বিশ্বস্ত। নারুর বউটা খুব ভালো রান্না করতে জানে।এককালের সম্ভ্রান্ত কৃষক পরিবার এরা। আশির দাঙ্গায় সর্বস্বান্ত হয়েছে। এখন এখানে থাকে। এরাই এইসব দেখেটেখে রাখে। যারা কাজ করে তাদের পাওনাগণ্ডা লিখে রাখে। অনিন্দ্য এলে দেখায়।বেশ আনন্দে আছে এরা এখানে।আনন্দই এদের মাসোহারা। অনেক চেয়েও একটি টাকা দিতে পারেনি অনিন্দ্য। যতটা হয়েছে এই কৃষিপৃথিবী, তাতেই এদের চলে যায়, কিছুই কিনতে হয় না।কেবল রান্নার তেলটুকু।আর জেনারেটরের ডিজেল অনিন্দ্যই নিয়ে আসে। কিন্তু ও না এলে এরা সেটা চালায় না। হ্যারিকেন দিয়েই চালিয়ে নেয়। আজকাল অনিন্দ্যও হ্যারিকেনে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। কী সুন্দর আলো। যতটা চাই, ততটাই, আলোর অপচয় নেই।

এইসব ভাবতে ভাবতে যেন একটু ঘুমঘুম লাগল। তড়াক করে সে দেখে নেয় ছোটো স্লিং ব্যাগটা।মনভূম সে নারুদাকে দিয়ে যাবে।নারুদা ছাড়া কে আর পারবে একে রক্ষা করতে? ছোটোবেলা থেকে এদের কোলেপিঠেই মানুষ হয়েছে সে। উর্বর মাটির মতন গায়ের রং, উজ্জ্বল ফসলের মতন চেহারা। এরাই অনির স্বপ্নকে বয়ে নিতে পারবে। বলবার আগেই নারুদা আর তার বন্ধ্যা স্ত্রী বুঝে ফেলে, কী চাইছে অনি। সবকিছু অত সুন্দর করে সাজায়।এইখানে কী সুন্দর লক্ষ্মীপুজোর আয়োজন করে কারা? কারা প্রতিটি গাছকে এক-এক করে চেনে? এদের কাছে দেবে না তো, কাকে দেওয়া যাবে? দানসংক্রান্ত সব পেপার্স এই ব্যাগটাতে। আর এটা সে দেবে ওই এনজিও-র সঙ্গে চুক্তি করে। কাজ থামানো যাবে না।প্রজেক্ট শেষ করবার সবটা টাকাই এদের দিয়ে যাবে। আর যতটা পেনশন আসবে, তাতে ওর হয়ে যাবে। স্বাতীকেও পাঠানো যাবে। সে অন্যকিছু করে ফেললে? করুকগে। বিয়েই তো করবে, আর গাড়িবাড়ি এসব। শুধু মনভূমের জন্য মন পুড়বে, বুঝতে পারে অনি।ব্যাঙ্কও মনে পড়বে। হঠাৎ স্বেচ্ছা অবসরের চিঠি পেয়ে ব্যাঙ্ক অবাক। কতবার ফোন এল। এমনকি হেড অফিস থেকে ই-মেল এল।  এসব আর এখন ভাবতে চায় না।তখন সারাদিন মনভূম নিয়েই ভাবত সে,কী নাম দেওয়া যায় এই অরণ্যের? অনেক অনেক নিদ্রাহীন রাত কাটিয়েছে সেই ভেবে। সতীশ একটা সাইন তৈরি করে দিয়েছিল।কাঠের। খালি রেখে গিয়েছিল। নাম ঠিক করে নিয়ে তাতে লিখবার জন্য। সেই প্রিয় মাটির ঘরে শুয়েই নামটা মনে এল একদিন। এখন তো কৃষি, পার্মাকালচার ছাড়া কিছু পড়ে না। আর খালি এ সংক্রান্ত ভিডিও দেখে নেট খুঁজে খুঁজে। কী একটা পড়তে গিয়ে মানভূম শব্দটা এল।সেটা একটা জায়গার নাম।তাকে একটু পালটেই এই মনভূম।

ঘুমঘুম ভাব। কিন্তু ঘুম আসছে না। একটু নির্ভার লাগছে বটে, কিন্তু মন শান্ত হচ্ছে না।

  কিছু দেবে না এবার?

  কোনবার দিই না?

  সোজা করে কথা বলতে পারো না?

  সরি, কী দিতে হবে বল

  টয়োটা ফর্চুনা

  সে আবার কী?

  ওই দেখ, গাড়ি আরকি। কী সুন্দর পুরুষালী, মাসকুলার

  গাড়িরও মাসল?

  সে তুমি বুঝবে না

  হুম

  কী হুম?

  কত?

  বেসিকটা আঠাশ আর সুপারটা চৌত্রিশ।

লাফ দিয়ে উঠে বসে অনি, চৌত্রিশ লাখ’?

  আমার জন্য যেটা রেখেছিলে, সেটা ম্যাচিউর করেছে। তুলে এনেছি। দশ ওখানে হয়ে যাবে। বাকিটা ফিনান্স করিয়ে নেবে। একটু একটু করে ইএমআই ।

  মানে? লোন নিতে বলছ?

  সবাই তা করে, পুরো টাকা দিয়ে গাড়ি কে কেনে?

  টাকাটা তুলে নিয়ে চলে এলে?

  সেটা তো আমার

  তোমার? তো, তাতেই তো একটা গাড়ি হয়ে যায়। চৌত্রিশ কেন? আর আমি তো ওই টাকা রেখেছিলাম, মনভূমে একটা গোটারি করব বলে।

  এই তো চাষার ছেলে বেরিয়ে এল। গরুছাগল ছাড়া মাথায় কিছু থাকে না।আসেও না। সারাক্ষণ গায়ে ওসবের গন্ধ।

চুপ হয়ে যায় অনি। এই খোঁটাটা খেতে খেতে সত্যিই রোগগ্রস্ত হয়ে গেল সে। কতরকমের এসেন্স, কত বডি স্প্রে, স্নানের জলে মেশানোর সুগন্ধি যে সে কেনে। বস এলে, কাস্টমার এলে, কোনো মহিলার কাছাকাছি গেলে নিজের নাকে নিজের গন্ধ পায়। কুঁকড়ে যায় ভেতর থেকে। সবচেয়ে অসুবিধে হয় মিটিঙের সময়।

ধীরে উঠে চলে যায় এখন। স্টাডিতে চলে আসে। বসে থাকে। একটু হুইস্কি বানিয়ে খায়। মাথা ভোঁ ভোঁ করে।

এঘরেই উঠে এল স্বাতী

  আমি সবাইকে বলে দিয়েছি। আর ওদের সেলসেও কথা বলেছি।কালকে একজন আসবে। কী কী লাগবে সব নিয়ে যাবে। গুছিয়ে রেখো। কালই যেন দিয়ে দেওয়া যায়। ওরাই সবটা প্রসেস করবে।

  আই হেট লোন। তুমি জান, কত লোক সর্বস্বান্ত হয়ে যায় শখের জন্য ঋণ করে? হয় দশের মধ্যে কোনো গাড়ি কিনে ফেল, নাহয় ওই টাকা আমাকে দাও। গোটারিটা দরকার।

  মানে? ছাগল হল নেসেসিটি আর গাড়ি শখ? থাকো তুমি ছাগল নিয়ে, সকালেই আমি যাচ্ছি।

আরেকটু মদ খেয়ে নেয় অনি, আচ্ছা

  হোয়াট ডু ইয়ু মিন, আচ্ছা?

  যেও

ধুপধাপ করে বেরিয়ে যায় স্বাতী। কী যেন ভাঙছে। কাচের কিছু হবে। ইস পা কাটবে কাটুকগে। আজ আর যায় না ও-ঘরে।এসব দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে অনি। বরং একটা স্প্রে বের করে সারা শরীরে মেখে নেয়। মাথা ঝিমঝিম। তার মধ্যেই সিদ্ধান্ত পাকা করে ফেলে। চলে যাবে সে।

মুখটা তেতো লাগছে। এখন রাত। বাসের বাতি জ্বলেছে। খুব খেটে খেটে যাচ্ছে বাসটা। রাস্তা খুবই খারাপ। মাঝে মাঝে অবশ্য স্পিডও দিচ্ছে। লোকটা ঘুমোচ্ছে, নাক ডাকছে। এভাবে যাচ্ছে কেন বাসটা? যেন উড়ছে। সকলে ঘুমোচ্ছে আর বাস যেন উড়ছে। এক মুহূর্ত পরেই বুঝে ফেলে অনি, গাড়িটা পড়ে যাচ্ছে। কত গভীর খাদ কে জানে। চোখ বন্ধ করে রাখে সে। সবাই চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করছে।আর্ত। লোকটা ঘুমোচ্ছে পাশে। দুবার ঠেলল, আর তখুনি হুড়মুড় করে গাড়িটা মাটিতে পড়ল। অন্ধকার হয়ে গেল সব।

কী অন্ধকার, কী অন্ধকার! বাইরে বৃষ্টির ছাঁট এসে চোখেমুখে লাগছে। কেউ কি বেঁচে আছে? নিজেকে হাতড়ে দেখে অনি। কিছুই হল না তার? এমনকি চশমাটাও অক্ষত, মোবাইলটাও ঠিকঠাক। জ্বালে সেটাকে। কী বীভৎসভাবে পড়ে আছে লোকটা, টাকার ব্যাগটা সিটে। সেখানেই তার একটা পা। বাকি শরীরটা কেমন বেঁকিয়ে গিয়ে সামনের সিটের হেলানের ওপরে রক্ত রক্ত কী করবে ভাবতেই মাথাটা ঘুরে গেল অনির। তড়াক করে টাকার ব্যাগটা হাতে নেয়। লাথি মেরে মেরে জানালার কাচ ভেঙেই ফেলে। কিন্তু বেরোতে পারছে না। কোনওমতে শরীরের ওপরটা বের করে আনে অনি। বাইরে থেকে কে যেন খুব জোরে টান দেয় ওর দুহাত ধরে। বেরিয়ে আসে সে। সামনে সেই বামনটা।

একটা মাঝবয়সী মানুষ। তিনফুট হবে? কিন্তু ওর শরীরে অত শক্তি? অনিকে বের করে বামনটা সেই টাকাওয়ালা লোকের শরীর ধরে টানাটানি করছে। সারাক্ষণ ওই লোকটার সঙ্গেই ছিল। খাবার সময়েও।জল এনে দিচ্ছে। একটু খইনি ডলে দিচ্ছে। সে ছিল আইলের অন্যদিকের সিটে, ওদের পাশেই। এখন কী করা যায়? ভিজে একসা হয়ে গেছে। মোবাইলটা নিভিয়ে দেয়। হাতে টাকার ব্যাগ। অনি একটা অন্ধকারের দিকেই হাঁটতে শুরু করে দিল।

কী একটা লেগেছে পায়ে, চিনচিন করছে। কিন্তু তেমন কিছু নয়। অনি হেঁটেই চলেছে। বৃষ্টি হচ্ছে অবিরাম। কত লোক মরে গেল? কত যেন ব্যথায় কাতরাচ্ছে। কাউকে ফোন করা যায়? ফোন বার করে। আলো। কিন্তু টাওয়ার নেই। ফোন পকেটে রাখতে গিয়েই আবার দেখল ওই সাদা পোশাকের বামনটাকে। নীরবে পিছু নিয়েছে সে। টাকার ব্যাগটা আরও শক্ত করে ধরে অনি। হাঁটে। বামনের কি পায়ের শব্দ হয় না? অত নিঃশব্দে সারাটা পথ ফলো করে আসছে? এখন তো প্রায় দুমিটার দূরত্ব রেখে হেঁটে চলেছে। কিছু বলছেও না। কেবল ফলো করছে। পেচ্ছাপ পায় অনির। সারা শরীর ভেজা। বৃষ্টিও। অনি দাঁড়ায় না। হাল্কা করে দেয় নিজেকে। পা বেয়ে নেমে যাচ্ছে জল। হাঁটা বন্ধ করে না।

কতটা হেঁটেছে ওরা? বামনটা সামনে আসে না। কিছু বলেও না, নীরবে আসছে। একটা সাদা রং আছে পেছনে। বোঝা যাচ্ছে। অনি পেছনে না তাকিয়েও দেখতে পায়। ও কি ভাগ চাইবে টাকার? নাকি ওর কোমরে গোঁজা আছে পিস্তল? ওরা কোনো গ্যাঙের নয় তো? অনি ভাবে না। সে কেবল অন্ধকারে একটা পেশল গাড়িকে দেখতে পায়। সকাল হলেই ফিরে যাবে। সব টাকা স্বাতীর কাছে দিয়ে চিরকালের জন্য মনভূমে। একটা ডিভোর্সের ছোটো মামলা করতে হবে খালি। কিন্তু এমন দুর্বল লাগছে কেন? আর প্রস্রাবও থামছে না। অত জল কোথা হতে এল শরীরে? বৃষ্টি বলে? অনি ফোনটা জ্বালে। দেখে। জল নয় বেরিয়ে যাচ্ছে রক্ত। কোনো ব্যথা নেই, কিছু নেই। কেবল অনর্গল রক্ত বয়ে চলেছে। এই জায়গাটা সমতল। একটা টিলার ওপরে। অনি বসে, ক্লান্তি বেড়ে যায় অনেক। কেমন তেষ্টা পাচ্ছে। টাকার ব্যাগটা পাশে মাটিতে রেখে মাটিতেই বসে পড়ে।ছোটো ছোটো উলুখাগড়া।খোঁচা লাগল। গা করে না।একটু দূরে ওই সাদা বামনটাও বসেছে।নাকি শুয়ে পড়ল? নাকি ঠাস করে পড়ে গেল মাটিতে? মাথা ঝিমঝিম করছে। টাকাগুলো ভিজে গেল? কিন্তু এটা ঠিক কেমন অনুভূতি? অজ্ঞান হয়ে যাবে? কেমন শীত লাগছে তার। একটু জল আর উত্তাপ চাই। কেউ কি নেই কোথাও? বামনটাকে বললে রক্ত বন্ধ করতে পারবে? সবগুলো টাকা দিয়ে দিলে করে দেবে না? কিন্তু ও কেন এমন করে শুয়ে পড়ল? মরে গেল না তো? দূর দূর কোথাও কোনো আলো নেই। এটা কি আসামের জঙ্গল নাকি মেঘালয়ে? কেমন যেন একটা বমি ভাব। নিজের লিঙ্গটিকে চেপে ধরে অনি। একটা পেশল গাড়ি, একটা নিজের গড়া অরণ্য, একটা সুন্দর সম্পন্ন কৃষিজীবন সব ঘোলাটে হয়ে যায়। এ রক্ত থামবার নয়?  কী যেন মনে হতে পকেটে হাত দেয় অনি। দেশলাইটা বার করে। সবটা ভেজেনি, তবে অনেকটাই ভিজেছে। সাদা একটা টাকাভর্তি ব্যাগ, একটু দূরে সাদা একটা বেঁটে লোক আর পায়ের পথ ধরে গলগল রক্ত।গাড়িটা পড়ার সময় কোথায় লেগেছিল? তলপেটে নাকি ওইখানে? এখন আর কিছু ভাবতেই পারছে না। কেমন যেন অবশ হয়ে যাচ্ছে সব। তবু, অনি চেষ্টা করে একবার দুবার জ্বলল। হাতের আড়াল করে সাদা ব্যাগটাতে আগুনটা ছোঁয়ায়। ব্যাগটা প্লাস্টিকের। প্রথমে জ্বলতে চায়নি। কয়েকবারের চেষ্টায় জ্বলে উঠল। বৃষ্টিও এখন কম। কেবল রক্তটাই বন্ধ হচ্ছে না। ঘুম আসছে, ঘুম।

 প্রকাশিত: মায়াজম, উৎসব সংখ্যা ২০২০ 

বৃহস্পতিবার, ২ জুলাই, ২০২০

ডোবারম্যান



অশোক দেব

ডোবারম্যান


এক

শুয়ে অন্ধকারে চোখ মেলে থাকাটাই ঘুম। সদানন্দের নিদ্রা। চোখের সাম্নে নানা রঙের বলয় তৈরি হতে থাকে। কখন ভোর হবে ভাবতে ভাবতে ভোর হয়। পাখি ডাকে, ঠিক তখন কিচ্ছু না জানিয়ে সদার ঘুম আসে।

সদানন্দ স্বপ্ন দ্যাখে। দ্যাখে, একটি ঘর, মেঝে একদম তকতকে, মন্দির যেমন। ছাদ থেকে ঘণ্টার মতো ঝুলছে অসংখ্য রাবারের তৈরি পুরুষাঙ্গ। দুলছে। কখনো, কোনো কোনো সময় এসবকে আসল বলে মনে হয়। গা বেয়ে রক্তও ঝরতে দেখা যায়। মেঝের মাঝখানে শুকনো রক্তের আলপনা। তাতে বসে আছে রানী মাসি পদ্মাসনে। নগ্ন, টান টান। চোখ আধবোজা। পুরো ঘরটার একটা উলটো ছবি মেঝের মধ্যে বিম্ব। সদানন্দ ঘুম ভেঙে তড়াক করে উঠে বসে।

ভয়ে ভয়ে নিজেকে একবার আঁতিপাঁতি খুঁজে দেখে স্বপ্নটাকে ভুলে যায়।
এসব আবার আরেকজন জানে কীভাবে? জানি, কারণ, সদা এমন একজন যে, অনেক সময় সে শুধু ঠোঁট নাড়ে, কথাগুলো বলে দিই আমি। সিনেমায় যেমন গান হয়।

সকাল হল। সবকিছু ওপাশে রেখে বেজে ওঠে নটার সাইরেন। ওয়াটার সাপ্লাইয়ের কল তিনবার হেঁচকি তুলে জল দেয়া বন্ধ করল প্রায়। খড়ধোয়া। অফিস টান দিল হ্যাঁচকা টানে পায়খানার লাইন। কোথাও জাগল হরতাল। কাশ্মীর জাগল। পাঞ্জাব জাগল। খবরের কাগজ জেগে ওঠে আর সদানন্দ বিড়ির কৌটোকে ডাকে। দেশলাই ডাকে। কাঁথায় পিঁচুটি মোছে, বিড়িজল খেয়ে বাইরে যায়। প্রথমে বাতকর্ম। পরে ইত্যাদি। সঙ্গে সঙ্গে চায়ের দোকান নাম ধরে ডাকবে ওকে।

সদানন্দ ভাড়া থাকে। অর্থাৎ বাপের সঙ্গে শেষব্দিও মেলানো গেল না। মনে হয় জন্ম থেকেই এরা খিঁচড়ে ছিল। সদানন্দের সুখের নাম কী? কী কৌতুক আর কী যে কান্না!

আমার গত এক হপ্তা ধরে নখ দাড়ি বাড়ছে না

হাঃ বলে কী, ডাক্তার দেখা

এটা রোগ নয়, স্থায়ী মানবজন্ম

গাছ নড়চড়ে উঠলো বাতাসের খেয়ালে। কখনো ইংরেজি, হিন্দি কিংবা কখনো বাংলায় সদানন্দ কথা বলে। এইখানে মাঠ। তাতে ঝাঁকড়া এই এক বটগাছ। তাঁর নীচে সদানন্দের বিকেল হয়।

আজকাল আর তেমন ডিম দেখা যায় না, যার কুসুম এই অস্তের সূর্য। বটগাছের কোনো ভাষা নেই। সদার সান্ধ্য ঠিকানা। তারপর ছেলে পড়াতে যাবে। পথে কোনো এক ফকিরের দরগা আছে। সদানন্দ মোম চুরি করে এবং ঘরে এসে বাল্ব নিভিয়ে মোম জ্বালে।

দৈনিক কাগজ, কম্পিটেটিভ পরীক্ষা দেবার বই। একটা টেবিল লাইট হাত দিলে শক্‌ করে, এই হল টেবিল। কিছুদিন পরেই চাকরির পরীক্ষায় বসা যাবে না। বয়স সীমা ছাড়িয়ে যাবে। তবু দিন হয় দিন আর রাত হয় রাত।

এক পেট জল স্বাভাবিক। কখনো ভাত লঙ্কা আলুসেদ্ধ হলে হলে ঢেঁকুর ওঠে। সদা হাঁটতে থাকে। দরোজায় লাগানোর তালা ছিল। তার চাবি নিরুদ্দেশ।
রাস্তার সব ইট উড়তে থাকে, সব সুরকি, জোনাকি।
সদানন্দ রাষ্ট্রসংঘের মহাসচিব কোন দেশের লোক?

 ইজিপ্ট, না... না... হ্যাঁ ইজিপ্ট।
Mr. Sadananda, do you know the story of genesis in the Bible? How man came on earth as per the Bible? Do you agree that man was created by God?

কী জানি! পা কাঁপে আমার। পেটের ভেতর কোঁৎ করে শব্দ হয়। খাইনি কিছু।

বরং একটি জন্মের কথা ধরা যাক। সদা একদা সমুদ্র দেখেছিল। তার বাঁ পাশে মা আর ডান দিকে বাবা। সামনে যতদূর চোখ যায় এ কী! কিসের সামনে দাঁড়ালাম! মা তারপর কী? সন্ধ্যা হচ্ছে, মা আর বাবাকে অনেক দূর হেঁটে যেতে দ্যাখে সদানন্দ।

সদা ঘরে ফিরে আসে। ঘড়ি বারো পেরিয়ে গিয়েছে। এই রাতে যাবার জায়গা বলে এক পায়খানা। বিড়ি দেশলাইও যায়। অযথা বিড়ি টানে। গর্তের মুখে সিমেন্টের স্ল্যাব। এই হল পায়খানা। নীচে জলের মধ্যে শব্দ হয়। কাতারে কাতারে মশা আর আরশোলা বেরিয়ে স্ল্যাবের মুখ দিয়ে। আজগের খবরের কাগজ মনে করে সদানন্দ। আজ একটি কিশোরকে পাওয়া গেছে একটি ডোবার জলে। তার নাকে রক্তের দাগ। পচে গন্ধ।
Q.11. Polyandry means
সদা পায়খানা থেকে বেরিয়ে আসে।

দুই.


ঘরের কোনে ফিতে ছিঁড়ে যাওয়া হাওয়াই, এক পাটি আরেক পাটির সঙ্গে হাসছে। আজও সকাল হয়েছিল। সন্ধ্যা হয়েছিল। আর রাস্তা থেকে চটি হাতে ফিরে আসে সদানন্দ। ছেলে পড়ানো হয় না। ঘরে এসে গভীর রাতের জন্য অপেক্ষা করা হল। বাইরে থেকে বেড়ার একটু তার ছিঁড়ে এনেছে সদা। কিছু কিছু মানুষ সব কাজ গভীর রাতের জন্য রেখে দেয়। তার দিয়ে ছেঁড়া ফিতে জোড়া লাগালে চটির হাসি বন্ধ হল। পা গলিয়ে ঘরেই একটু হেঁটে নেয়, তারপর বিছানায় যায় সে। বিছানা হল তার টাইম মেশিন। ওটাতে করে অতীতে যাওয়াটাই সদানন্দের পছন্দ।

সদানন্দ ভেবে দেখেছে যৌবন আসার আগে সকলে মৃতই থাকে। কারণ, একজন যুবকই ভাবতে পারে, বড়লোকের ডোবারম্যান যেমন, আমাদের ঘরের ছেলেরাও তা। ঘেউ। কাকে ঘেউ? কেন? তবু ঘেউ।

তথাপি একটি নদীর কাছে যাতায়াত। গোপনে আমি আছি তোমার হয়ে। তোমার জাতের নই, তাতে কী? ওই চোখের কী জাত? প্রতিদিন একটি করে চিঠি লেখা। স্বপ্নের রং কখনো নীল কখনো ঘোর স্কারলেট। বাড়িটার নাম হবে বৃষ্টি। সামনের দেয়ালে আমিই এঁকে দোব ছবি। সদর দরোজা থেকে দুধারের সার বাঁধানো দেবদারু। হাওয়ায় এরা দুলবে আরামে। ঘরের রং হবে  চাপা সবুজ। আমাদের শোবার ঘর হাল্কা নীল। আমাদের মনে থাকবে আমাদের বাস। মায়ের ঘরের সঙ্গে ঠাকুর বাবার ঘরে আস্ত লাইব্রেরি। তোমাকে নিয়ে যাব প্রতিদিন এক নদীর কাছে।

কিন্তু সব চুল ছেড়ে দিলে নারীকে কেমন মনে হয়? প্রশ্নের সাথে সাথেই সদানন্দের মনে হয় সমস্ত ঘরটা ঝুপ করে শব্দ করল। সদা টাইম মেশিনে উবু হয়ে শোয়।

টাইম মেশিন। অতীতকাল। সব চুল ছেড়ে দিলে নারীকে কেমন দেখায়? তার চুলে লাগানোর গার্ডার কোথায়? রানিমাসি দাঁড়িয়ে আছে সোজা। তার শাড়ি হল হাওয়ার প্রতীক। সদানন্দ দূর মাঠ ধরে ছুটে আসছে। তার কানে কোনও ডাক এসে পৌঁছায় না

তোর নাম টা বিচ্ছিরি। এ নামে আমি ডাকব না।

সদানন্দ নিজের নাম পাল্টে ফেলে মনে মনে। প্রকাশ্যে পারে না। সকলের তো সব হয় না। নিঝুম হয়ে সদা রানিমাসির পায়ের কাছে বসে। তার নখ থেকে খুটে খুটে রং তুলে নেয়।

ঘরের মেঝেতে খপ করে একটা টিকটিকি পড়ল। সদা পাশ ফিরে তাকে দেখে। সঙ্গে সঙ্গে পাশের বাড়িতে ক্যাবল টিভির শীৎকার কানে আসে। আবার টাইম মেশিন।

রানিমাসি সদাকে কোলে তুলে ঘরে নিয়ে আসে। ঘর মানে সুযোগ। সন্ধ্যা মানে রানিমাসি পেছন ফিরে কাপড় তোলে। টেবিলে কনুই রেখে দাঁড়ায়। সদানন্দকে পেছন থেকে টেনে নেয় অদ্ভুত কায়দায়। এবার একটা ডোবারম্যান ঘোঁত ঘোঁত করে। সব শিথিল করে তারপর বাতাস আসে। অ্যাতোক্ষণ এইসব কোথায় ছিল? এই ঘর, এই হাওয়া? আলো জ্বলে। ঘেউ ঘেউ। পকেট থেকে একটা চিঠি বের করে সদানন্দ দেয়, মাসি,

আমাকে বৌদি ডাকলি না কেন, প্রথম থেকে? কী রে?

প্রতি সন্ধ্যায়, নিয়মিত যে, প্রতিটি সন্ধ্যায় এইভাবে সদানন্দ একটি ডোবারম্যানকে ভালো করে বুঝে উঠতে পারে না। কার চিঠি কাকে দিয়ে ফেলে! অথচ সদার কাছে একটি নদীও ছিল।

সদা আপনমনে চলে আসে এক শহরে। একপ্রান্তে তার ঘর অন্যদিকে দুনিয়া। কাঁহাসে কাঁহা পহুঁচ গয়া! বাইরে এক জ্যোৎস্না। সদা আকাশের দিকে মুখ তুললে সারারাত ঊর্ধ্বদৃষ্টি কাটিয়ে দেবে। গাছের আনাচে কানাচে তাই জ্যোৎস্না দেখে, আকাশে তাকায় না। কে কাক, ডাকছ? কাকে? রাতকে তোমার দিন মনে হয়?

শহরের বড় বড় বাড়িতে এখন কিছু লোক জাগছে। সদানন্দ আদের চেনে। খবরের কাগজ চেনে। এ সপ্তাহে সদা মোট ১০ জন মানুষের মৃত্যু জেনেছে। এখন রাস্তায় বলে বলে বিক্রি করে কিছু ছেলে। গৃহবধূ ধর্ষিতা, শ্বশুর গ্রেপ্তার। তছলামারায় সাত ব্যক্তি খুন। ওই লোকগুলোর কাছে রাত্রি এক রকম। কাউয়া কা। আমার কাছে এক। কাউয়া কা। সদা এদিক ওদিক হাঁটে। এদিকে ঘাস আছে ওদিকে উঠোন। সদানন্দের পায়ে হাওয়াই চটি। সদ্য লাগানো লোহার সরু তার ব্যথা দিচ্ছে খুব। ঘরে চলে এসো। আসার আগে সদা আকাশে তাকায়। চাঁদ, তুমি নীল আর্মস্ট্রংকে চেন?

বিছানা।

   মাসি, স্কুলে তুমি কী পড়াও?
মাসি স্নানঘর থেকে এসেছে। একটু গায়ে থাক তুই, মাসি অমন করে

   ভালোওওবাসা

   চুল খুলে দাও। আমি গন্ধ নেব। দেবও। আসলে সদা জমিয়ে রাখা থুতু মাখায় চুলে।

বিড়ি দেশলাই। সদা রাত কাটাতে যায়। পায়খানার দরোজায় একটা ব্যাঙ। ওকে দেখে লাফাতে লাফাতে নিরাপদ অন্ধকারে চলে যায়। আজকের কাগজে যে বউটির কথা, তার শ্বশুরের সাথে স্বামীও জড়িত ছিল।

তিন.

Q.5. where are days and nights equal throughout the year and why?

জানি না তো, আহা, সমান?

এই তার শেষ বছর। আর কোনও পরীক্ষা দেওয়া যাবে না। চাকরির আশা হত হল। সদা চারদিকে তাকায়। মেয়েটির চশমাটা টেবিলে উলটো হয়ে মেয়েটিকে দেখছে। তার কিন্তু সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। ওই ছেলেটি বাচ্চা। জানালাগুলো এদিকেরটা ওদিকেরটাকে দেখিয়ে দেখিয়ে বাতাস খাচ্ছে। ওই মেয়েটির চুল ছেলেদের মত ছাঁটা। একটি ছেলে রোগা, আর এটি হয় ধামসা। ধুর।সদা বেরিয়ে যায়। দরোজা কানে কানে বলে, এসো এসো, দুগগা দুগগা। মহিলাদের কলেজে ছিল পরীক্ষা। সদা সেটি ছেড়ে এসে এখন রাস্তায়।

বাহ, আহা, আর সংবাদপত্র দরকার নেই। কম্পিটিশন সাকসেস পড়ার প্রয়োজন নেই। পরীক্ষা নেই। এখন আমি যেমন খুশি। রাস্তায় এখানে ওখানে গর্তে জল জমে আছে। সদা পেরিয়ে পেরিয়ে হাঁটছে সেদিক দিয়ে। এমন একটা সময় ছিল আমরা ওকে ছবি আঁকতে দেখেছি। এমনও দিন গেছে সে ম্যান্ডোলিন বাজাত। সদা এমন ভাবে দাঁড়াতে জানত, দেখলে মনে হত দেবে যাচ্ছে মাটি। এখন, এখন হাঁটতে হাঁটতে শিস বাজাচ্ছে, সুর নেই তাতে।

শহরে এক যে ছিল রাজা। তার প্রাসাদ এখনও আছে। পতাকা পাল্টে গেছে। প্রাসাদের সামনে রাজপুকুর। মাঝে রাস্তা দুপাশে দুটি।  এক পাশে টুপ করে বসে পড়ে সদা। পকেটে কটি টাকা আছে। সেগুলোকে  ঘাসের ওপর কলমচাপা দিয়ে কিছুক্ষণ সাঁতার কেটে নিল। পাড়ে উঠে পোক্ত করে বসেছে, যতক্ষণ না জামা কাপড় শুকিয়ে যায়।

কোথাও কিছুক্ষণ বসে থাকার যো নেই। ভিজে কাপড়ে খুব জোর সি পেয়েছে। পেছনে রাস্তা, সামনে পুকুর। কোথায় যাব, আড়াল নেই। খুব জোর। সদা দাঁড়াতে দেরী কর্মটি হয়ে যেতে দেরী হয় না। আমাদের স্থায়ী মানবজন্ম নিজগাত্রে প্রস্রাব করে এবার নাইতে নেমেছে। একবার সাঁতার শিখলে কেউ তা আর ভোলে না।

আমাদের বাড়ির সামনে একটি পুকুর ছিল। সদানন্দ ডুব দিয়ে পুকুরকে একটা গল্প বলে। আমাদের বাড়ির সামনে একটি পুকুর ছিল। তোমার মতন বড় কিন্তু নয়। তবে অনেকে সাঁতার কাটতে আসত। যেমন ধরো, বিনু, রাধে, বিলাস। আমারও কপাল থেকে চাঁদের টিপ মুছে গিয়েছিল। তারপর একদিন পুকুরে চাঁদের বিম্ব হল। আমি দেখলাম। আমার শরীরে বিদ্যুৎ এসে খেলা করে যায়। কেমন মায়া লাগে। রানিমাসি যে, মাসি এ কথা বুঝতে পেরেছিল। আমাকে ডাকত। কেমন মন্ত্রের মতন কাজ। আমি যাই। মাসি তার দুধ খুলে খেতে দেয়। অনেক চুষতাম । দুধ নেই। অন্য বুকে মাসির ছোট ছেলেটা দুধ খেত। কী জানি দুধ আসত কি না। রানিমাসির বাড়িতে একটা রাক্ষসও ছিল। সেলফিশ জায়েন্ট। তার হয়ে মাসি রক্ত শুকিয়ে তারপর গুঁড়ো করে কপালে লাগিয়ে রাখত। নইলে রাক্ষস রাতেরবেলা তাকে পিষে ফেলতে চায়। মাসির অনেক কষ্ট। তাই রাক্ষসকে দেখিয়ে দেখিয়ে সে আমাকে আহ্লাদ করত। সন্ধ্যায় নিজে পুকুর হয়ে আমাকে বলত, সাঁতার কাট। এত কথা একসাথে বলে সদানন্দের জলের নীচে শ্বাস আটকে আসে। ওপরে উঠে এলে ভেসে ওঠে রাস্তা, মানুষ, রাজপ্রাসাদ। হিহি, ধ্যুত, আমি না খুব মিথ্যে বলি। রাজপুকুরকে বলে। আমি একটা ল্যাজকাটা ডোবারম্যান। হি। ঘেউ ঘেউ। পুকুরের খুব মায়া হয়। বলে, সন্ধ্যা হল, বাড়ি যাও।

শহরের সব রাস্তাকে ঘুরেফিরে সদানন্দের বাড়ির পথের কাছে আসতে হয়। ওদিকে হাসপাতাল আছে। হাসপাতালে রাত হয় অন্ধকার। ওই হাসপাতাল ছাড়া এ শহরে আর কোনও গণিকাপল্লী নেই। সদানন্দ যেকোনও একটি পথে হাঁটে। একটি চকচকে ভ্যানিটি ব্যাগ হঠাৎ পথের কোন্‌ থেকে ডাক দেয়। ও কাছে যায়, কলম আর টাকা রয়ে গেছে পুকুরের পাড়ে। পেছন ফেরে না, বরং আরও কাছে যায়। যেতেই মুচকি মুচকি হাসে ব্যাগটি। সদাও হাসে। এদিক ওদিক তাকিয়ে নজর করে দেখে ব্যাগটিকে। দেখে কী, ও এখন মুখ কালো করে তাকিয়ে আছে। পড়ে থাকা ব্যাগ দেখলে পুলিশে খবর দিন। ওই, ওই। মাথায় আতস। পালা, পালা। দৌড়। শ্বাস। আহা আহা। হা হা। কানে কোনও শব্দ বেজে ওঠে না। তবু সে ছুটছে। তার ঘরটিও ছুটছিল তার দিকে। নাহয়, এ পথ সদা এল কী করে ইশারায়?

আজ রোববার। বাড়িঅলা অন্য জায়গা থেকে ফিরে আসে। এই যা। আজ সদারও ছুটি। এই তো স্টোভের সামনে  ঘরের ভেতর। ইনিয়ে বিনিয়ে বলে, আজ জ্বল ভাই, কাল থেকে অত জ্বলতে হবে না। স্টোভও না পারতে জ্বলছে। তার কী দোষ। সদা ভাবে, এসবের মানে কী? আমি কেমন করে হাঁটতে পারি। ঠান্ডা ঘরে ঢুকে অবলীলায় বলতে পারি, গুড মর্নিং স্যার। ফিরে আসার সময়, এনি মোর কোশ্চেন,প্লিজ? না, কোনও প্রশ্ন তো থাকে না। হিহি করে হেসে ওঠে একটা বাটি। সদা সেটাকে তুলে নিয়ে তাল বাজায়। দূরে টেবিলে সকল কাগজপত্র নাচতে থাকে। সংবাদপত্র, খুন, ধর্ষণ নাচে, নাচে উগ্রপন্থী নাচে। সম্পাদক নাচে। নাচে প্রতিদিন নাচে, নাচে কারেন্ট অ্যাফেয়ারস নাচে। সদার পায়ের ঠিক নেই। চুপ। চিড়চিড় স্টোভ জ্বলছে। একটা অদ্ভুত আলো ঘরের ভেতর। বিদ্যুতের আলো কখন চলে গেছে। একটি একটি করে সব কাগজ সদা স্টোভের ওপর ছুঁড়ে মারে। সব, খবরের কাগজ, লেখার কাগজ, কম্পিটিশন সাকসেস। সারটিফিকেটস। অনেক কাগজের নীচে পড়ে বোধহয় সদার স্টোভ শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছিল। নাহলে দাউ দাউ আগুন জ্বলল না কেন?

চার.

হাসপাতালের কিছু গন্ধ পোষ্টবক্সটির ভেতরেও ঢুকে আছে। তবু এ নিয়েও লাল ডাকবাক্স ঠায় সেঁটে থাকে দেয়ালে। যে লোকটি এগিয়ে আসে, তাকে দেখলেই বোঝা যায় তার একটি বাড়ি আছে, ভাড়া খাটে। চিঠিখানি বাক্সে পড়ে শব্দ করল। লোকটা খানিক তাকাল বাক্সের দিকে। তারপর চলে যায়।

সদার দিনের বেলা পিঁপড়ে আর রাতের বেলা আরশোলা। সারা দিনরাত ঘরে থাকে সে। টিকটিকিদের তার বিশ্বাস নেই। শহরের টিকটিকি মিছেকথায় তিন ডাক ডাকে।

মাঝে মাঝে কাঁদে সদানন্দ। মাঝে মাঝে চেয়ে থাকে। হাসি পেলে থামে না। প্রথমে চেয়ে থাকে, যেমন এখন,  স্থির, যেন সত্যিই দেখতে পাচ্ছে উড়ে গিয়ে পড়ে যাচ্ছে কাক, চড়ুই, শালিক। ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে কান।

আবার নীরবতায় হাহা করে চারদিক। বনপায়রা এসেছে মরতে। মাথা গুঁজে মরে আছে অনেক পাখি। গম খেতে এসেছিল তারা। সিরাজ মিয়াঁ  ক্ষেতে ওষুধ দিয়েছিল। সদানন্দ এর পেছনে ছুটে যায়, ওর পেছনে যায়। সন্ধ্যা হল এভাবে। সদা অনেক পাখির শব কুড়িয়ে এনেছে। গর্ত খুঁড়েছে। অনেক বড়। সবাইকে সেটাতে মাটি দিল। রাত হয়ে গেছে। গম ক্ষেত অন্ধকার। একটা কড়া গন্ধ হচ্ছে বাতাসে। সদার মাথায় রক্ত উঠে যায়। বাড়ি হতে নিয়ে আসে একটা দেশলাই, কেরোসিন। গম ক্ষেত জ্বলে ওঠে দাউদাউ।

ধরতে পারে ওরা, ধরতে পারে। বাবা গো মেরো না। সদা যেন স্পষ্ট ব্যথা পায় এখনও। অশরীরী হয়ে বাবা তাকে এখনো মারছেন। এইসব দেখে কেঁদে ওঠে সদানন্দ। সে জানে না একটা ডাকবাক্সও আজ তার জন্য কেঁদেছে। নীল একটা ইনল্যান্ড লেটার পড়ে নিয়েছিল সেই ডাকবাক্স।

আপনাদের পুত্র শ্রীমান্‌ সদানন্দের আচরণে একপ্রকার সন্দেহ হইতেছে ।তাহার চুলে জটা ধরিয়াছে এবং চোখেও অদ্ভুত দৃষ্টি আসিয়াছে ।কাহারো সহিত কথা বলে না।নিজে নিজেই হাসিয়া এবং কাঁদিয়া উঠে ।মাসখানেক ধরিয়া স্নান খাওয়া প্রায় বন্ধ করিয়া দিয়াছে ।আপনারা আসিয়া একবার দেখিয়া যাইবেন ।অন্যথায় আপনাদের পুত্রের এই দায়িত্ব গ্রহণ করিতে পারিবনা ক্ষমা করিবেন ।

ডাকবাক্সের কষ্ট হয়েছিলো ।সদারও কত খাম সে দেখেছিলো ।বায়োডাটা, ব্যাঙ্কড্রাফট,বয়েসের মানপত্র, সার্টিফিকেটসের জেরক্স, কয়েকখানা সদ্য তোলা ছবি।সদা তো আর অপরিচিত কেউ নয় ।

 

পাঁচ

মার সঙ্গে বাবাও এসেছিল ।মাথায় হাত রাখে বাবা, মনে হয় মাথা ফুঁড়ে সমস্ত অভিমান আজ বেরিয়ে যাবে ।এমন হয়না ।শুধু কৌতুক, না-কি সদা এমন হাসা হাসলো, এত লজ্জা এ্যাতো কাঁদলো ।

এদিকে আমাদের শহরে মৃদু ভূমিকম্প হয়েছে একদিন ।অনেকের বিয়ে হয়ে গেলো।রাতের বেলা আকাশ দিয়ে এরোপ্লেন যায় ।শীত পড়লো খুব ।আমরা তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে আসতাম ।

অনেকদিন সদাকে আমরা মনে রাখলাম না ।আমাদের অনেক বাইরে যে সদা অনেকগুলো বছর কাটিয়ে দিয়ে আসে, তারও কেবল তিনজনকে মনে আছে ।আজ ফিরে আসার পর তাদেরকে মনে করে না সে। তবু তার মনে আছে ।সদা এখন ভাবে তিনজন বলতে একজন মহিলা, জান্‌লায় দাঁড়িয়ে থাকে সারাদিন ।বিকেল হলে কাঁদে আর কাকে যেন টাটা দ্যায় ।তার বয়েসী একটি ছেলে সারাদিন ধ্যানে বসে থাকে ।ধ্যানেই তাকে জোড় করে খাওয়াতে হয় ।ধ্যানেই তার সবকিছু ।আর ওই ডাক্তার ।টাক হলে মানুষের চেহারা যেমন গম্ভীর হ্য়, তারও তেমন ।এমন একটি লোকই সদাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলো,

Do you know who Jocasta was?

   রানি মাসি ।

এ প্রথম ফিরে আসার পর সদা বেশি করে হেসে ওঠে ।

 

তার ঘর ।সব ঠিকই পায় সে ।সারাদিন আড্ডা মারতে ইচ্ছে করে এত ঝরঝরে হয়েছে সদা ।তবে কারো কথা জিজ্ঞেস করলোনা ।সন্ধ্যায় আমরা দুজন নদীর পাড়ে অনেক পাখির ডাক শুনলাম ।ওর প্রিয় ব্র্যাণ্ডের সিগারেট খেলাম ।আরো ধীরে সন্ধ্যা কালো হয় ।সদাকে বাড়ি দিয়ে আসা ঠিক হবে ।

 

আজও ও আলো নিভিয়ে দ্যায় ।মোম নিয়ে পুরোনো ছবিগুলিকে দেখলো ।একটু একটু হাসলো ।ড্রয়ার থেকে অনেকগুলি পুরোনো চিঠি বের করে আনে ।টেবিলের সাম্নে বসে ।

 

চেয়ারটাকে নাড়িয়ে চাড়িয়ে আগের আরাম পর্যন্ত যায় ।একটি বই নিয়ে শব্দ করে পড়েহুঁ হুঁ সমস্ত বেগই আপেক্ষিক বেগ ।কারণ পৃথিবীতে প্রকৃত স্থির বলিয়া কোন বস্তু

হেসে ওঠে ।পড়ার সুরটাও বেশ মনে আছে ।মোম জ্বেলে দেয়ার পরই ওকে ভালো করে চোখে পড়ে ।তবু এতক্ষণ না দেখার ভান করেছে ।এবার হাত দিলে তার শব্দও আগের মতো খসখসে ।আজকের কাগজ-ই তো ! সদা প্রথমে হেডলাইন দেখে ।দুলাইন সম্পাদকীয় পড়ে ।এ পাতা ও পাতা ।বিজ্ঞাপন ।রোববারের আলাদা পাতা ।না, নাই-তো ।আগের মতো নাই-তো ।ওসব এম্নিতেই চোখে পড়ে অত দেখতে হয়না ।তবু দেখে সদা ।বাইরে আকাশে আজও  জ্যোৎস্না ।ওঘরে একটু টিভি দেখে আসা হলো ।আবার, খস খস ।না-নাই ।ধর্ষণ, খুন, হত্যা ।নাই ।অন্য, অন্য রকম সবকিছু ।মোমের কাছে অনেক পোকা আসে ।সদা তাদেরকেও ভালো মতো দ্যাখে ।তাদের ডানার রঙ জলের মতো ।বারবার আগুনে লেগে যাচ্ছে কই পুড়ছে না তো ।এবার স্যুইচ টেপে সদা ।আঙুল দিয়ে কলামের ওপর থেকে নীচ অব্দি আসে।না।স্যুইচ অফ্।আবার মোম জ্বালে ।কাগজটি বিছানায় ছুঁড়ে দিয়ে ফিক্‌ ফিক্‌ হাসে ।

 

রাত্রি নীরব হয়ে ওঠে ।খেয়ে আসার পর ।বিছানার দিকে যেতে ভয় করে সদার।কাগজটা আছে। তবু হাতে নিয়ে চোখের সাম্নে ধরে রাখে ।দ্যাখে না ছাই-ও।

রানিমাসি এখানে নেই ।রক্তও না ।মাসিকে অপারেশন করে নারীর কম করা হয়েছিলো মনে আছে ।মাসিও মুটিয়ে গ্যাছিলো ।তার যেন যন্ত্রণাই কমে গ্যাছিলো অনেক ।সব যন্ত্রণা কি ঐ অপারেশনে কেটে গিয়েছে? কাগজটিকে ফেলে রাখে সদা।বাবাও এখন আর ততো রাগী নয় ।

 

মোম নিভে গেলে ঘরের মধ্যে সব অন্ধকার ।বাড়িতে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে ।

 

মা চা না দিলে সদা ঘুম থেকে ওঠেনা ।বাইরে থেকে ডাকলে উঠে গিয়ে চা নেয় ।কুঁজো থেকে জল নিয়ে মুখ ধোয় ।আজও কুঁজো ঘরের কোনে, মায়ের বাঁ পায়ের শব্দ ডান পায়ের চেয়ে বেশি হয় ।কুঁজো তা শোনে আর ভয় পায় ।আস্তে দু তিনবার মা ডাকে ।দরোজা খোলে না ।কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ঠেলা দ্যায় ।ভেজানোই ছিলো ।খুলে গেলে একরাশ আলো হুমড়ি খেয়ে পড়ে মেঝের মাঝখানে উল্টে রাখা চেয়ারে ।হাত থেকে কাপ প্লেট প্রথম শব্দগুলি করে, তারপর মা ।দরোজার এক পাটে হেলান দিয়ে মা স্থির হয়ে যায় ।বুকের কাছে এসে যায় চিবুক ।চোখ বন্ধ ।নীরব ।ঘরের কোন্‌ থেকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে জলের কুঁজো ।মায়ের পায়ের কাছে এসে কাত হয়ে জল দিতে থাকে ।তার ভেতর সমুদ্র ছিলো, ভেসে যাচ্ছে গতকালের কাগজ ।The king is dead, long live the king. সমুদ্রের সকল ঢেউ মেঝের সামান্য ওপরে সদানন্দের পা-ও স্পর্শ করে ।   

[প্রকাশিত : পদক্ষেপ, ১৪০১]


পাঠের জন্য ধন্যবাদ। এই অতিমারির কালে গাছের সঙ্গে সময় দারুণ কাটে